আহা ঈদ!

বিশ্বের যুদ্ধবিদ্ধস্ত এলাকাগুলোর মানুষদের চিত্র আমাদের সামনে প্রায় প্রায় উঠে আসে মনিটরের পর্দায়। কি করুণ মানবেতর জীবন। প্রতি বছর ঈদের সময় এসব এলাকার ঈদের খবরও মিডিয়ায় আসে। আমরা ২ সেকেন্ডের জন্য আফসোস করি, 'আহারে! এদের এই ঈদও কি ঈদ?' দীর্ঘস্বাসটা বেরিয়ে যেতে না যেতেই ফিরে যাই নিজেদের উদযাপনে। কখনো কল্পনাতেও আসে না, এমন কোনো ঈদ আমাদের জীবনে আসতে পারে।

না, যুদ্ধ দেখতে হচ্ছে না। ওরকম বিভীষিকার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে না আমাদের। তবে যা দেখতে হচ্ছে, তাও কি কখনও দেখতে হবে বলে ভেবেছি? এই আজকেই, পৃথিবীর সুপার পাওয়ার আমেরিকায় সব মিলিয়ে মৃত্যু ১ লাখ ছাড়িয়ে গেলো! আমাদের দেশে প্রতিদিন গোটা বিশেক মৃত্যুর খবর পাচ্ছি 'অফিসিয়াল' হিসাবে।

প্রিয় চাচা চাচী ফুপুরা রমজান মাসে কয়েকবার করে আসতো একগাদা ইফতার বানিয়ে, এবার কোনো আসা যাওয়া নেই। সবগুলো পরিবার যেন নিজেদের বাসায় বসে বসে পঁচে যাচ্ছে। আমেরিকার করোনা পরিস্থিতির একেবারে এপিসেন্টার নিউ ইউর্কে বেশ কয়েকটা প্রিয় মানুষ প্রতিদিন কাটাচ্ছে অবরুদ্ধ আতঙ্কে। আগে শুনতাম অমুক দেশে করোনা। তারপর শুরু হলো নিজের দেশে, অমুক জেলায়, ওই এলাকায়। তখনো মনে করতাম, এখনো তো দূরেই আছে। এখন কানে আসছে, পেছনের গলিতেই কেউ আক্রান্ত। দুই গলি পরেই কেউ মারা গেছে, গলি লোকডাউন। কোনো কাজিনের ফ্রেন্ড পরিবারসহ আক্রান্ত। এখনও কি খুব দূরে? বৃত্তটা ছোট হয়ে আসছে। দম বন্ধ বন্ধ লাগছে।

ফ্রেন্ডস, কলিগসদের সাথে কোনো দেখা হওয়ার সুযোগই নেই। পুরো রমজান চলে গেল। তিনটি জুমার নামাজ ছাড়া মসজিদে ঢুকিনি! মসজিদের ভাইদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ নেই। দ্বীনি মজলিসগুলো বন্ধ। মনটাকে হালকা করার রাস্তাগুলো কোনোটাই আর খোলা নেই।

রাত পেরোলেই ঈদ। অথচ কালকের দিনটাও ঠিক গত প্রায় তিনটা মাসের প্রতিটা দিনের মতোই কেটে যাবে চার দেয়ালের মধ্যে।

আর সেই সাথে আছে সার্বক্ষণিক মাথার মধ্যে চেপে রাখা আতঙ্ক। অফিসের কাজ করে যাচ্ছি বাসা থেকে। বই পড়ছি অনেক বেশি। কখনো গল্পের বই, কখনো কোরআন, হাদিস, ইতিহাস। আমার পিএইচডি রিসার্চের কাজও চলছে আগের চেয়ে বেশ ভালো গতিতে। সেই সাথে প্রতিদিন মেডিটেশন, এক্সারসাইজ। আর রাতে তারাবীহ তো আছেই। কিন্তু যতই নিজেকে ব্যস্ত রেখে ভুলে থাকার চেষ্টা করি। যতই ছোট করে দেখার বা দেখানোর চেষ্টা করি। নিজেকে ধোঁকা দিয়ে লাভ নাই। পরিস্থিতি কতটা খারাপ, এবং সামনে ভয়াবহতার আশংকা কত বেশি, তা সবাই কম বেশি বুঝছি। দীর্ঘদিন ধরে এই চেপে রাখা anxiety এর ফল অনেক খারাপ।

এর মধ্যেই রমজান পেরিয়ে গেলো। পেরিয়ে যাচ্ছে ঈদ। কি বলবো সবাইকে? নিজেকে? ঈদ মোবারক?

কিছুদিন আগে আমার বাবা ফোনে আমাদের খুব ঘনিষ্ট একজনকে বললেন, আমাদের উচিত বেশি করে আল্লাহ'র কাছে মাফ চাওয়া। সেই 'ভদ্রলোক' তাতে জবাব দিলেন, আমরা কী ভুল করলাম যে মাফ চাব? আহারে, কতটা নির্বোধ হতে পারি আমরা?

জানিনা সবার চোখে ভুল ধরা পড়ে না কেন, আমি তো অনেক ভুল দেখি। একের পর এক ভুল করে গেছি আমরা। দিনের পর দিন। বছরের পর বছর। নিজেদের ক্ষতি করে চলেছি অনবরত।

একবার মনে করে দেখুন তো, এই করোনা আসার আগে, প্রতিদিন খবরের কাগজের হেডলাইনগুলো কেমন ছিল? কি ধরণের খবর দেখতে হতো প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে? এরকম একটা সমাজ আমার চারপাশে, অথচ আমার সব চিন্তা ফিকির নিজেকে নিয়ে, নিজের আরাম আয়েশ নিয়ে। এটা কি ভুল না?

অর্থনৈতিক এমন এক ব্যবস্থা দাঁড়া করিয়েছি, যেখানে লাভটাই সব। আর বাকি সব চুলোয় যাক। তাই সব জ্ঞানীগুণীদের সতর্কবাণী তোয়াক্কা না করে বন জঙ্গল উজাড় করে ফেলেছি। সাগরের পানি কালো করে ফেলেছি। আকাশের নীল রং শহরের মানুষ ভুলতে বসেছিল করোনা আসার আগে। এই অবস্থা তৈরী করা কি ভুল না? এমনকি এই দুর্যোগের মধ্যেও ব্যবসায়ীরা আছে সুযোগ বুঝে টাকা কামানোর ধান্দায়। এগুলো কেউ ধরিয়ে দিলে বলবো, এসব ব্যাপারে আমার কি হাত আছে? এই স্বার্থপরের মতো উত্তরটা দেয়াও কি যথেষ্ট বড়ো একটা ভুল না?

ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিচ্ছি কোনো না কোনো স্ক্রিনের আলোর দিকে তাকিয়ে। যার অধিকাংশই আমার কোনো উপকারে আসছে না। এটা কি ভুল না?

বাবা মা'কে কাছে পেয়েও অনবরত অবহেলা, দুর্ব্যবহার করে যাচ্ছি। আত্মীয়দের সাথে কথা হয়নি মাসখানেক, কোনো খোঁজ নেইনি। ভুল করিনি?

এভাবে লিখতে থাকলে লেখা চলতেই থাকবে।

তবে সবচেয়ে বড়ো ভুল করেছি নিজের অস্তিত্বকে ভুলে গিয়ে। আমার বেঁচে থাকার কারণ কি? খাওয়া দাওয়া। কোনো না কোনোভাবে টাকা কামানো। থাকার জায়গার একটা ব্যবস্থা করা। একটা গাড়ি হলে ভালো হয়। বিয়ে করা, বংশ বিস্তার করা। তারপর ব্যবসাটা আরেকটু বড়ো করা। বাড়িতে আরেকটু ডেভেলপমেন্ট করা। নতুন আরেকটা গাড়ি কেনা..... এই সাইকেলের মধ্যেই একদিন মরে যাওয়া। এটাই কি জীবনের উদ্দেশ্য? তার মানে পশু পাখির লাইফ সাইকেলের সাথে আমার তেমন একটা পার্থক্য নেই? নাকি আমাকে আরো কিছু দায়িত্ব দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছিল? কখনো খুঁজেও দেখিনি জীবনের মানে, সৃষ্টির উদ্দেশ্য, স্রষ্টার পরিচয়। এর থেকে বড়ো ভুল কি আছে?

হ্যা, মনে হয় এর চেয়েও বড় একটা ভুল আছে। আর তা হলো পরম দয়াময়ের ভালোবাসার থেকে, তাঁর অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ে যাওয়া। যত কঠিন সময়ই আসুক, তাঁর দিকে না ফেরা। যতই মন ভেঙে যাক, তার কাছে মন খুলে কাঁদতে না পারা। কোরআনের এই আয়াতটায় আসলে তাই সবসময় ইমোশনাল হয়ে যাই, একটু থেমে যাই, 'হে মানুষ! কোন জিনিস তোমাকে তোমার সেই মহান প্রতিপালক সম্পর্কে ধোঁকায় ফেলেছে?' আমাদের এতো এতো ভুলের পরেও সবচেয়ে বড় ভুল হবে তাঁকে ভুলে যাওয়া। সব চেয়ে বড় ভুল হবে, নিরাশ হয়ে যাওয়া।

আগামীকাল বাসায় কোনো মেহমান আসবে না। ৫ মিনিটের রাস্তা ভেঙে বোনের ফ্যামিলি আসবে বাচ্চাগুলো নিয়ে। ভাইয়ারা আছে নিচতলায়, দেখা হবে। ব্যাস এতুটুকুই ঈদ। তারপরেও মা আজকে সারাদিন ধরে রান্না করে যাচ্ছে, তার ছেলের বৌকে সাথে নিয়ে। প্রতি ঈদের মতোই এবারও তার ট্র্যাডিশনাল মেনু থাকবে। পোলাও, রোস্ট, গরুর রেজালা, কাবাব। ডেজার্ট হিসেবে ক্ষীর, হালুয়া etc etc. আমি আর বাবা দুজনেই কয়েকবার বলতে চেয়েছি, কেউ তো বাইরে থেকে আসছে না, নিজেরা নিজেরাই। তারপরও এতো কিছু.... লাভ হয়নি। মা রেঁধেই যাচ্ছেন। বয়স্ক মানুষটার সারা শরীর দিয়ে ঘাম ঝরছে। রাতের খাবার খেতে বসেছি, তখন সে যাচ্ছে একটু ফ্রেশ হতে। যাওয়ার আগে বুটের ডালের হালুয়াটা প্লেটে বাড়তে বাড়তে বলে গেলেন, 'যদি কোনো আশা না থাকে, উদযাপন না থাকে, আনন্দ না থাকে, তাহলে বাঁচা যায় না।'

তাই বলতেই হচ্ছে, ঈদ মোবারক। আগামীতে আবার আনন্দময় ঈদের আশায়, ঈদ মোবারক। 


Comments

Popular posts from this blog

নূরের শহরে (২) - উপহারের রাত

The Sundarbans 2009 - Part 4: The Prolonged Ending

Sylhet 2009 (Day 3): The Other Side of the Fence