বুক রিভিউ: মুহাম্মাদ (সঃ) - হৃদয়ের বাদশাহ

আল্লাহ'র রাসূল (সঃ) এর জীবনী পড়া হয়েছে কয়েকটা। শুরুটা ছিল আমার প্রিয় একটা বই, Martin Lings এর Muhammad -  His Life Based on the Earliest Sources বইটা দিয়ে। প্রথম সীরাত-পাঠ হিসেবে জেনারেল শিক্ষিতদের জন্য খুবই ভালো একটা অপশন। পরবর্তীতে পড়া হয় বিখ্যাত The Sealed Nectar , বর্তমানে সবচেয়ে বেশি পঠিত সীরাতগুলোর মধ্যে অন্যতম। আরও কিছু সীরাতের বই পড়া হয়েছে তবে একটানা পুরোটা না। অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম আরেকটা সীরাত শুরু করা দরকার। আমার ওয়াইফও আমাকে বলেছে বেশ কয়েকবার। বর্তমান মহামারীর শুরুর সময় থেকে পরিচিত আলেমদের থেকে শুনছি, এই সময় সীরাতের চর্চা করা জরুরি।

কোনটা পড়া যায়? রাশিদ হাইলামায এর লেখা Sultan of Hearts এর কথা শুনেছি অনেক। মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে মুহাম্মাদ (সঃ) - হৃদয়ের বাদশাহ  নামে বেরিয়েছে বাংলা অনুবাদও। ওই প্রকাশনার আদম আলী ভাই বেশ কয়েক বছর ধরে আমার পরিচিত। প্রফেসর হযরতের মাদ্রাসার দফতরে অনেক দিন খোলামেলা আড্ডা হয়েছে ভাইয়ের সাথে, হয়েছে এক সাথে কিছু দ্বীনি সফরও। উনার লেখার ভক্ত আমি এবং আমার ওয়াইফ দুজনই। খুব সহজ সাবলীল ভাষায় উনার অবজারভেশনগুলো তুলে ধরেন। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, "ভাই, হৃদয়ের বাদশাহ'র অনুবাদ কি আপনার করা?" ভাই বললেন, "হ্যা"। আমি বললাম, "তাহলে আমার লাগবে"। ভাই 'সুবহানআল্লাহ' বলে হাত বাড়িয়ে দিলেন চেয়ারের পাশেই রাখা একটা ব্যাগে। যেন আমাকে দেয়ার জন্যই রেডি ছিল বইটা! দুই খণ্ডই কিনে নিলাম সাথে সাথে। সেদিন রাত থেকেই নিয়মিত তালিমের অংশ হিসেবে পড়তে শুরু করলাম, আমি আর আমার স্ত্রী এক সাথে।





সীরাতের বই সবগুলো সব ধরণের পাঠকের জন্য উপযুক্ত না। কিছু বই একেবারে গল্পের মতো করে সাধারণ পাঠকের জন্য লেখা। যেমন মার্টিন লিংসের বইটি। কিছু আছে একেবারে গবেষণাধর্মী, যেগুলো মূলত ইসলামী লাইনের ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য। কিছু আছে দুটোর মাঝামাঝি। পাঠকের ক্ষেত্রে বইয়ের ভাষাও খুব গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। জেনারেল লাইনের অনেক পাঠক দ্বীনি বইপত্র পড়তে আগ্রহ পায়না। এর অন্যতম কারণ হয়তো বইয়ের গুরুগম্ভীর ভাষা এবং অনেক তত্ত্ব বিশ্লেষণ। বিগত কয়েক বছরে জেনারেল লাইন থেকে দ্বীনের পথে আশা বেশ কিছু তরুণ লেখকদের মাধ্যমে অবশ্য এই ট্রেন্ডটার বেশ পরিবর্তন এসেছে আলহামদুলিল্লাহ। 

রাশিদ হাইলামায তার বইয়ে আল্লাহ'র রাসূলের (সঃ) জীবনকে গল্পের মতোই তুলে ধরেছেন। নবীজির (সঃ) জন্মের আগে থেকেই কিভাবে বিশ্ব তৈরী হচ্ছে সর্বকালের শ্রেষ্ট মানুষটির আগমনের জন্য, সেখান থেকেই গল্পের শুরু। তারপর ধীরে ধীরে উনার জন্ম, বেড়ে ওঠা, সমাজ সংস্কার, নবুওয়াত ...... বাকিটা তো সত্যিই ইতিহাস! অতুলনীয়, অবিস্মরণীয় ইতিহাস। আল্লাহ'র রাসূলের (সঃ) জীবন-গল্পের প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি চরিত্রই গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে যারা আল্লাহ'র রাসূলের (সঃ) সঙ্গী ছিলেন, তাঁদের  জীবন যেমন শিক্ষণীয়; দ্বীনের জন্য তাদের আত্মত্যাগের কারণে, রাসূলুল্লাহ'র প্রতি তাদের ভালোবাসার কারণে, দুনিয়া ছেড়ে আখেরাতমুখীতার কারণে। ঠিক এর উল্টোপিঠে, দুনিয়ার জীবনের তথাকথিত সকল 'সফলতা' সত্ত্বেও আল্লাহ'র রাসূলের শত্রুদের চরম ব্যার্থতাও শিক্ষণীয়। সীরাতের ওই বইটিতে এই রাসূল্লাল্লাহ'র (সঃ) জীবনের গল্পের ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরা হয়েছে কখনো বর্ণনা আকারে, কখনও বা এসব চরিত্রদের মাঝে কথোপকথনের মাধ্যমে। 

তবে এই গল্প নিছক আর দশটা গল্পের মতো না। সীরাতের চর্চা শুধু একটা গল্প পড়ার জন্য না। বরং এই গল্পের প্রতিটি পৃষ্ঠা থেকে মুমিনের জন্য আছে শেখার উপকরণ। তাই সেই শিক্ষণীয় দিকগুলোও লেখক তুলেন ধরেছেন গল্পের ফাঁকে ফাঁকে। নবীর (সঃ) কাছে নতুন কোনো আয়াত নিয়ে আসলেন জিবরাঈল (আ:), এই আয়াত এখন কেন? এই আয়াত নাজিলের মাধ্যমে আল্লাহ মুমিনদের কিসের জন্য প্রস্তুত করছেন? কোনো নতুন বিধান এসেছে কুরআনের কোনো আয়াতের মাধ্যমে। এই বিধান মুমিনদের জন্য কেন দেয়া হলো? এই সময়ে কেন দেয়া হলো? এধরণের আলোচনা, খুব বেশি গভীরে না গিয়েই, তুলে ধরেছেন লেখক। 



একদিকে একেবারে গল্পের বইয়ের মতো সহজ সাধারণ সীরাত, আর অপরদিকে আলোচনা-পর্যালোচনা-গবেষণাধর্মী কিতাব, এই দুয়ের মাঝে একেবারে Sweet-Spot এ মনে হলো এই বইটিকে। 
বইটি নেয়ার আগে আদম আলী ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বইটি তার অনুবাদ করা কিনা। কারণ আমাদের মতো সাধারণ পাঠকদের জন্য সাবলীল এবং contemporary ভাষায় দ্বীনি বই বা আর্টিকেল লেখার ক্ষেত্রে উনি যোগ্যতার পরিচয় রেখেছেন। অনেক আগে থেকেই তাই আমি তার লেখার ভক্ত। তাই এই বইয়ের অনুবাদটা যে প্রাঞ্জল হবে, সে ব্যাপারে আমার কনফিডেন্স ছিল। বইটি পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে, অনুবাদটা একেবারে আমার আশানুরূপ। যেমনটা এক্সপেক্ট করছিলাম উনার অনুবাদ থেকে, ঠিক তেমনই। 



রমাদ্বান চলে আসছে। আমাদের পড়া প্রথম খন্ডের মাঝামাঝি। এরপর দ্বিতীয় খন্ড আছে। আদম আলী ভাইয়ের কাছে শুনলাম, তৃতীয়টাও ছাপানোর জন্য প্রস্তুত। বর্তমান পরিস্থিতির কারণে সেটা বের হওয়া পিছিয়ে গেছে। তবে আমি তাড়াহুড়ো করে বই পড়তে পছন্দ করি না। বিশেষ করে যেই বই পড়ে দেখি যে পড়তে মজা লাগছে, সেটা ধীরে ধীরে পড়ি। দ্রুত পড়লেই তো হুট্ করে শেষ হয়ে যাবে। তাই এই বইটাও অল্প অল্প করেই পড়ছি।  

বইটির লেখক এবং অনুবাদকের শ্রমকে আল্লাহ তাআলা তাদের আখেরাতের জন্য অনেক বড় ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে কবুল করুন। সবাইকে আল্লাহ তাঁর রাসূলের (সঃ) সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন গড়ার তৌফিক দিন। আমিন।   



Comments

Popular posts from this blog

Sylhet 2009 (Day 3): The Other Side of the Fence

মন্ত্রমুগ্ধ

ড: হাসিবের গল্প