ড: হাসিবের গল্প
এনার্জি কনভার্শন কোর্সের প্রথম ক্লাস আজ। থার্ড সেমিস্টারের ছাত্ররা ক্লাস শুরুর আগে বসে আড্ডা দিচ্ছে। সময়মতোই ক্লাসে ঢুকলেন ড. হাসিব হায়দার স্যার। এই স্যারের ক্লাস আগে করেনি ওরা, তবে নাম শুনেছে বড় ভাইদের কাছে। হাসিব স্যারের ক্লাস নাকি ভার্সিটি লাইফে সবচেয়ে মজার। সেই সাথে স্যার নাকে খুব ফ্রেন্ডলি আর মোটিভেশনাল। স্যারের এই কোর্সের ব্যাপারে সবারই তাই বেশ উৎসাহ।
স্যার রুমে ঢুকেই উজ্জ্বল একটা হাসি দিয়ে বললেন,
‘কি অবস্থা সবার??’
‘ভালো স্যার’
‘অল্প ভালো নাকি বেশি ভালো?’
‘বেশি ভালো স্যার’
সব ক্লাসেই টিপিকাল একটা ফাজিল থাকে, সেরকমই একটা পেছন থেকে বলে উঠলো
‘বেশি ভালো নাই স্যার’
‘কেন?’
‘সেমিস্টারের প্রথম দিন, আর আপনারা ক্লাস নিতে এসে পড়লেন। একদিন না পড়াইলে কি হইতো?’
হাসির রোল উঠলো ক্লাসে। হাসিব স্যারও হেসে দিলেন তার বিশাল হাসি,
‘আরে আজকে পড়াবো কেন, পাগল নাকি?’
‘তাহলে আজকে কি হবে স্যার?’
মনে হয় অনেকটা মন খারাপ করেই জিজ্ঞেস করলো ফার্স্ট বেঞ্চের ভারী ফ্রেমের চশমা পড়া আঁতেল।
‘তোমাদের সাথে প্রথম ক্লাস। তোমাদের সাথে গল্প করবো। তোমাদের পরিচয় জানবো।’
একে একে হাসিব স্যার সবার পরিচয় নিলেন। বাড়ি কোথায়। প্ল্যান কি। হবি কি। এই সব আর কি।
সবার বলা শেষে বোর্ডে নিজের নাম বড় করে লিখলেন,
Dr. Hasib Haider.
‘স্যার আপনার কথা বলেন এবার।’
‘আরে আমার কথা তো বিশাল লম্বা! বলতে গেলে পুরা কোর্স লাগবে একটা।’
‘অল্প কিছু বলেন স্যার, আপনার পড়াশুনার কথাই না হয়…’
সামনের বেঞ্চের আঁতেলটা চশমাটা নাকের উপর ঠেলে দিয়ে বললো,
‘স্যার, আপনার পিএইচডি করার গল্পটাই শোনান।’
হাসিব স্যারের চেহারায় হঠাৎ কেমন যেন পরিবর্তন দেখা গেলো। কিছুক্ষনের জন্য কালো হয়ে গেলো মুখটা। দৃষ্টি যেন সরে গেলো খুব দূরে কোথাও। যেন অনেক দিন আগের কোন দিনে ফিরে গেছে মনটা।
খানিক পরেই আবার তার হাস্যজ্বল এক্সপ্রেশন ফিরে আসলো,
‘হ্যা, এই গল্পটা বলাই যায়!’
একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে , হেটে হেটে বলতে শুরু করলেন ড. হাসিব -
‘আমি যখন টিচার হিসেবে জয়েন করি, আমার তখন পিএইচডি ডিগ্রি ছিল না। শুধুমাত্র মাস্টার্স করা ছিল। কিন্তু রিসার্চের প্রতি আমার ছিল অনেক আগ্রহ। পিএইচডি তে ভর্তি হয়েছিলাম, কিন্তু চাকরির প্রেশারে সেটা আগায়নি বেশি দূর।
এদিকে আমার ক্লোস কলিগরা সবাই পিএইচডি-ধারী। আমার চলাফেরা, ওঠাবসা সবসময়ই তাদের সাথে। একসাথে রিসার্চ করতাম। পাবলিকেশন করতাম। বেশ কয়েকটা পুরস্কারও পেলাম রিসার্চের জন্য। ভার্সিটির সবাই আমাকে ভালো রিসার্চার হিসেবেই জানে। কিন্তু…..’
কিছুক্ষনের জন্য চুপ হয়ে গেলেন স্যার। ‘কিন্তু কি স্যার?’
‘কিন্তু রিসার্চ যাই করি না কেন, পিএইচডি নেই বলে সবসময় ডিপ্রেসড থাকতাম। এদিকে প্রমোশনও হচ্ছে না ডিগ্রির অভাবে। এভাবে মন মরা হয়ে যেতে লাগলাম দিনকে দিন। একদিন আমাদের সিনিয়র স্যার প্রফেসর কবির আমাকে ডেকে নিলেন তার অফিসে। তিনি আমার ডিপ্রেশনের ব্যাপারে জানতেন। বললেন,
‘দেখো হাসিব, তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করবো, ঠিক ঠিক জবাব দিবে, ওকে?’
‘অবশ্যই স্যার’
‘তুমি কি বিশ্বাস কর তুমি একজন রিসার্চার?’
‘জি স্যার’
‘তোমার কি তোমার পিএইচডি করা কলিগদের মতোই গবেষণা করতে ভালো লাগে?’
‘খুবই ভালো লাগে স্যার’
‘তুমি কি মনে করো যে তোমার রিসার্চ তোমার পিএইচডি-ধারী কলিগদের মতোই ভালো মানের?’
‘তা তো অবশ্যই, আমার রিসার্চ পেপারগুলো তো তাদের সাথেই লিখছি।’
‘তাহলে তুমি আজ থেকে, মন থেকে, গভীরভাবে বিশ্বাস করবে, তুমিও পিএইচডি করেছো।’
‘কিন্তু স্যার, পিএইচডি তো আমি আসলেই করিনি, শুধু মাস্টার্স করেছি।’
‘পিএইচডি না করে থাকলেও, তোমার আচার আচরণ, কথাবার্তা, কাজকর্ম, তোমার পাবলিকেশন, সব কিছুই ডক্টরেটদের মতো। তাই তোমার পূর্ণ অধিকার আছে নিজেকে ডক্টরেট বলে দাবি করার। নামের আগে ‘ড:’ লেখার !!’
কবির স্যারের কোথায় চোখে পানি চলে আসলো। কতদিনের অপূর্ণ স্বপ্ন! নামের আগে ‘ড:’ বসাবো! ভেবেছিলাম কখনোই পূর্ণ হবে না। কিন্তু না। সেই স্বপ্ন আজ সত্যি।
কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে পিএইচডি পাইনি ঠিকই, কিন্তু মনে প্রাণে, কোথায় কাজে আমি একজন ডক্টরেট। তাই সেদিনের পর থেকে, নিজেকে আর লুকিয়ে না রেখে, গর্বের সাথেই নিজের পরিচয় দেই …
Dr. Hasib Haider
রুদ্ধশ্বাস শুনছিলো সবাই। স্যারের গল্প শেষে সবাই এক সাথে উঠে দাঁড়িয়ে তালি দিয়ে উঠলো। কাউকে দেখা গেলো আস্তিনে চোখ মুছতে।
ব্যাক বেঞ্চার সেই ফাজিলটা চোখ মুছতে মুছতে এগিয়ে আসলো সামনে। স্যারের সাথে হাত মিলিয়ে বললো,
‘স্যার তাহলে আসি। ‘
‘আরে যাচ্ছ কোথায়, ক্লাস টাইম তো এখনো বাকি। Attendance নিবো না?’
‘স্যার, আমার আর এই কোর্স লাগবে না।’
‘তার মানে?’
আবেগ জড়ানো কণ্ঠে সে বললো, ‘স্যার, এই কোর্সটা এই নিয়ে তিনবার রিটেক নিলাম। পাশ করতে পারছিলাম না কোনোভাবেই। কিন্তু আমি সবসময়ই বিশ্বাস করি আমি এই কোর্স পাশ করার যোগ্য। আজ আপনার কথা শুনে মনে হলো, এই বিশ্বাসটাই আসল। আজ থেকে আমি বিশ্বাস করি, এই কোর্সে আমি পাশ করেছি। তাই আমার আর এই কোর্স করার দরকার নেই। থ্যাংক ইউ স্যার! থ্যাংক ইউ সো মাচ! ’
হাসিব স্যার খুশিতে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। অন্তত এই একটা ছেলের জীবনেও যদি পরিবর্তন এনে দিয়ে থাকেন, তাহলেই জীবন সার্থক।
গর্বে বুক ফুলে উঠলো তার!
Very nice
ReplyDeleteEbar holo to ?? Shamlan shamlan
ReplyDeleteAwesome
ReplyDeleteNice
ReplyDelete