নূরের শহরে (৪) - রহমতে, বৃষ্টিতে, অশ্রুতে ভিজে

আল্লাহর ঘরের নিমন্ত্রণ পাওয়া, তাঁর ঘরেরতাওয়াফের তৌফিক পাওয়া, তাঁর হাবিবের সামনে দাঁড়াতে পারা এমনিতেই ছিল আমার জন্য হঠাৎ পাওয়া অবিস্বাশ্য নিয়ামত, তার উপরে আবার আল্লাহ আমাকে নিয়েছেন বাবা মায়ের সাথে, সুযোগ দিয়েছেন তাদের কিছু খেদমত করার। একদিকে আল্লাহর গুনাহগার বান্দা, অপরদিকে বাবা মায়ের হক আদায়ে ব্যর্থ সন্তান, তারপরেও এতবড় দান আল্লাহর তরফ থেকে, এতো ভালোবাসা বাবা মায়ের কাছ থেকে! কেবল উনাদের থেকেই আসলে আশা করা যায়!

তো এই সফরে বাবা মা যখন মসজিদে যেতেন, বা বাইরে কোনো কাজে, সাথে সাথেই থাকতাম। খাবারের সময় খুঁজে খুঁজে মনমতো খাবার নিয়ে আসতাম হোটেলে। তবে সকালের দিকে বা দুপুরের পরে, যখনিই তারা বিশ্রাম নিতেন, আমি ফুড়ুৎ করে প্রায় উড়ে চলে যেতাম নবীর মসজিদে! হোটেল থেকে নামলেই মসজিদে নববী, ইশ কত খুশির সময় ছিল! এ সময়গুলো আমি চড়ে বেড়াতাম প্রিয় নবীর মসজিদের জমিনে। কিছুটা দ্বীনি শিক্ষা বা উপলব্ধি যাদেরকে আল্লাহ দিয়েছেন, তারা এই মসজিদের মর্যাদা বুঝেন। আরেকটু যারা আগে বেড়েছেন আল্লাহর দিকে, তারা টের পান এই মসজিদের নূর, এখানের রুহানিয়াত। অদৃশ্য জগতের আয়োজন সবার চোখে না পড়লেও, এখানের বাহ্যিক সাজসজ্জা চোখ এড়াবে না কারোরই। এখানের চোখ ধাঁধানো আর্কিটেকচার, ডেকোরেশন, লাইটিং দেখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। সেই সাথে মুসল্লিদের সুবিধার জন্য আছে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার। তবে আমাদের বড়োরা এসব জাঁকজমকের দিকে বেশি মনোযোগ দিতে নিরুৎসাহিত করেন। করারই কথা। প্রিয় মানুষকে আমাদের চোখে সুন্দর লাগে তার প্রতি মহব্বতের কারণে, আর তার গায়ের অলংকার সেই সৌন্দর্যকে একটু বাড়িয়ে দেয় কেবল। তবে সব আকর্ষণ যদি হয় ওই গলার হারের দিকেই, প্রশংসা যদি হয় শুধু হীরার আংটির, তবে কি সে খুশি হবে? হওয়ার কথা না।

আমার কাছে মনে হতো, এখানে এক এক জায়গায় বসে থাকা, নামাজ পড়া, তিলাওয়াত করার যেন এক এক রকম স্বাদ। রাসূল (স)-এর সময় তো মসজিদ এতো বড় জায়গা জুড়ে ছিল না, কিন্তু এই পুরো জায়গাটাই তো ছিল মসজিদের আশেপাশে। এসব স্থানে নিশ্চই পড়েছে আমার প্রিয় নবীজির পায়ের ছাপ! এসব জমিনে নিশ্চই ঘুরে ফিরেছেন আল্লাহর প্রিয়, নবীর প্রিয় সাহাবীরা। যুগ যুগ ধরে আল্লাহর সব প্রিয় বান্দাদের পা পড়েছে এসব মাটিতে, গুঞ্জন উঠেছে তাদের তিলাওয়াতের, জিকিরের, আল্লাহর বড়ত্বের আলোচনার; দরস হয়েছে কুরআনের, হাদিসের, ফিক্হের! তাই আমি ঘুরে বেড়িয়েছি পুরো মসজিদ, এ মাথা থেকে ও মাথা, প্রতিটি কোণে, যতবেশি সম্ভব। কখনও নামাজে, কখনো তিলাওয়াতে, কখন দুআয়; কখনো শুধুই বসে থেকে, কখনো একটু বিশ্রামে। এরকম একটু বিশ্রাম নিতে গিয়ে আজব অভিজ্ঞতা হলো একবার। মসজিদে নববীতে মূল সবুজ গম্বুজ ছাড়াও আরও কিছু গম্বুজ আছে। প্রশস্ত এলাকা জুড়ে মাথার উপর ছায়া করে আছে নজর কাঁড়া কারুকার্য করা এসব গম্বুজ। একবার খুব সম্ভবত বেশ ভোরে, সূর্য তখনও বেশি উপরে উঠেনি। মসজিদের এরকম একটা গম্বুজের নিচে বসে আছি, আশেপাশে মুসল্লিরা তেমন কেউ নেই। ভাবলাম একটু লম্বা হই। চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম কার্পেটের উপর, মাথার উপর বিশাল গম্বুজ। চোখ বন্ধ করতেই কখন যেন ঘুমিয়েই পড়লাম। ঘুম ভাঙলো কিছু পরে। চোখ খুলে আমি হতবাক, কোথায় আসলাম? ছিলাম শুয়ে গম্বুজের ছায়ায়, এখন দিকে মাথার উপর নীল আকাশ, গায়ে এসে পড়ছে দিনের আলো! একটু পরেই বুঝতে পারলাম বিষয়টা। এগুলো মসজিদের কিছু অত্যাধুনিক গম্বুজ। প্রতিদিন কিছু নির্দিষ্ট সময় আলো বাতাস প্রবেশের জন্য এগুলো নিঃশব্দে স্লাইড করে সরে যায় মসজিদের ছাদের উপর! আমার উপরেরটাও সেরকম সরে গেছে আমি ঘুমিয়ে থাকতে! সুবহানাল্লাহ!

এই মসজিদের কিছু জায়গা তো আছে অন্য সব অংশ থেকে স্পেশাল। 'জান্নাতের বাগানে' তো আল্লাহ চড়িয়েছেন সেই প্রথম রাতেই! এছাড়া রাসূল (স) এর রওজা শরীফের যে দিকে 'ক্বাদামাইন শারিফাইন' অর্থাৎ আল্লাহর হাবিবের মুবারক পা দুখানি, সে দিকের রওজার দেয়াল আর মসজিদের দেয়ালের মাঝে অল্প একটু জায়গা আছে। এখানেও ভিড় লেগে থাকে নামাজ পড়ার জন্য, অল্প সময় বসে আল্লাহর কাছে দুআ করার জন্য। এখানেও সময় কাটিয়েছি বেশ কিছুক্ষন। আরও আছে আসহাবে সুফ্ফার প্লাটফর্ম। নবীজির প্রিয় কত সাহাবী এখানে থেকেছেন আল্লাহর রাসূলের সোহবতে! (বর্তমান প্লাটফর্মটা অবশ্য তখনকার পজিশনে নেই, তার থেকে একটু পেছনে সরিয়ে নেয়া হয়েছে)

মসজিদের একেবারে সামনের অংশটা পুরোনো, তুর্কি আমলের। এই অংশে নামাজ পড়তেই সবচেয়ে বেশি ভালো লাগতো, যদিও এখানে মুসল্লিদের ভিড় একটু বেশিই থাকে সবসময়। তবে যদি জানতে চান, পুরো মসজিদের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা আমার কাছে কোনটি, তাহলে আপনাকে নিয়ে যাই এই পুরোনো অংশের আরেকটু পেছনের দিকে। মসজিদের মধ্যেই এখানে আছে একটা খোলা চত্বর। আর এখানেই বসে থাকতে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগতো আমার। চারপাশে ঘিরে আছে মসজিদের দালান। সারি সারি পিলার আর আর্চগুলো চলে গেছে যেন দৃষ্টির সীমা পর্যন্ত, দুপাশে আর পেছনে। কাতারের লাল কার্পেটগুলো এখানেও বেছানো আছে মার্বেলের ফ্লোরের উপর। তবে মাথার উপরে ছাদ নেই, আছে খোলা আকাশ! আর সামনে? সামনেই মসজিদের তুর্কি আমলের, ভাব-গাম্ভীর্যে পূর্ণ পুরোনো অংশ। বামপাশে কোণাকুণি তাকালেই চোখে পরে রওজা শরীফের গাঢ় সবুজ দেয়াল, সোনালী জালি। আর ঠিক সেই বরাবর উপরে, নীল আকাশের গায়ে ঝলমল করছে সবুজ গম্বুজ! এরকম একটা পরিবেশের মাঝে বসে থাকা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা করে প্রিয় হাবিবের দেয়ালের দিকে, ওই গম্বুজের সবুজের দিকে।

প্রয়োজনে ছায়ার ব্যবস্থা আছে অবশ্য। উঁচু উঁচু পিলারগুলোর গায়ে লুকিয়ে আছে অত্যাধুনিক ছাতা। এই ছাতাগুলো ছড়িয়ে আছে মসজিদের বাইরের চত্বরেও। রোদ-বৃষ্টিতে প্রয়োজনে এসব ছাতা ছড়িয়ে যায় পিলার থেকে, আস্তে আস্তে খুলতে থাকে, মাঝ থেকে বাইরের দিকে। তবে খোলা অবস্থায় ছাতাগুলো সাধারণ ছাতার মতো বৃত্তাকার নয়, বরং চারকোণা। মসজিদের মাঝের এই চত্বরের ছাতাগুলো যখন মেলে দেয়া হয়, এদের কোণগুলো প্রায় মিলে যায় একটা আরেকটার সাথে, একেবারে মসজিদের ছাদ বরাবর। ছাতাগুলোর মাঝের ফাক দিয়ে মাঝে মাঝে দেখা যায় আকাশ। প্রযুক্তির ব্যবহার আছে, কিন্তু প্রকাশ নেই। ছাতাগুলোর ডিজাইন মসজিদের আবহের সাথে মিশে যায় একেবারেই।

আর এই প্রিয় উন্মুক্ত চত্বরে, ছাতার নিচে একদিন পেলাম আরেকটা স্মরণীয় উপহার।

আসর পড়ার জন্য মসজিদে এসেছি। সেই ওয়াক্তে বাবা খুব সম্ভব বেশ ক্লান্ত ছিলেন, মসজিদে আসেনি। বাবার সাথে থাকলে তাকে নিয়ে এতটা ভেতরে আসতাম না, অনেক হাটতে হয় বলে। একা থাকলে আমি প্রায়ই নামাজে দাঁড়াতে চেষ্টা করতাম সামনের অংশের কোথাও। সেদিন দাঁড়ালাম এই খোলা চত্বরে। আকাশে মেঘ ছিল, সে জন্যই ছাতাগুলো পুরোপুরি মেলে আছে। জামাতের ইকামত হলো, নামাজে দাঁড়ালাম ছাতার নিচে। কিছুক্ষন পরেই শুনতে পেলাম শব্দটা, প্রথমে থেমে থেমে, অল্প অল্প। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকলো, বাড়তেই থাকলো। হ্যা, ছাতার উপর বৃষ্টির শব্দ! অল্প সময়ের মধ্যেই ঝুম ঝুম করে পড়তে শুরু করলো বৃষ্টি। ছাতাগুলোর মাঝের ফাঁকা দিয়ে বৃষ্টি আসছে মসজিদের ভেতর, ভিজে যাচ্ছে কার্পেট, ভেসে যাচ্ছে মার্বেলের মেঝে! আরেকটু পরে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগলো ছাতার কাপড় চুয়ে চুয়ে। নামাজের মধ্যেই ভিজে যাচ্ছি বৃষ্টিতে! সুবহানআল্লাহ! সুবহানআল্লাহ! সুবহানআল্লাহ! আমাকে যদি চিনে থাকেন (যেটার সম্ভাবনা কম), বা আমার লেখা আগে পড়ে থাকেন (সম্ভাবনা নেই বললেই চলে), তাহলে নিশ্চয়ই জানেন বৃষ্টি আমার কত প্রিয়। আমার অন্যতম প্রিয় কাজগুলোর মধ্যে কয়েকটা হলো বৃষ্টি দেখা, বৃষ্টির শব্দ শুনা আর বৃষ্টিতে ভেজা। কিন্তু কখনও কি কল্পনাও করেছি আমি ভিজবো এরকম এক জায়গায়? দাঁড়িয়ে আছি আল্লাহর হাবিবের মসজিদে, সামনেই প্রিয় নবীজির রওজা, সবুজ গম্বুজ; চলছে আসরের জামাত। একটু পর পর ইমাম সাহেবের গম্ভীর স্বরে তাকবীর, মুয়াজ্জিনের সুরেলা প্রতিদ্ধনি, আর সেই সাথে বৃষ্টির রিমঝিম। রহমতের পানি নামছে আকাশ থেকে, মসজিদে নববীর উপর ভেসে বেড়ানো, আল্লাহর পাঠানো মেঘ থেকে, এসে পড়ছে ছাতার উপর। এই ছাতা তো মসজিদেরই অংশ, মসজিদেরই ছাদ! রহমানের পাঠানো রহমতের বৃষ্টি, রহমতের নবীর মসজিদের ছাদ ফুঁড়ে এসে পড়ছে আমার মতো এক অযোগ্য বান্দার শরীরে! বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কিয়াম, রুকু; বৃষ্টি ভেজা মেঝেতে কপাল রেখে সিজদা! আল্লাহই জানেন, একমাত্র তিনিই জানেন, ওই মুহূর্তটা, ওই চার রাকআতের সময়টা আমার কাছে কত প্রিয় ছিল! হয়তো খুশির অশ্রু মিশেও গিয়েছিল বৃষ্টির পানির সাথে। নামাজ শেষ হতেই দেখা গেলো ছোটাছুটি, বৃষ্টি থেকে বাঁচতে সরে যাচ্ছে মুসল্লিরা, কার্পেট গুটানো হচ্ছে দ্রুত গতিতে। আমি বসেই থাকলাম অনেকক্ষণ। উঠে পড়লেই শেষ হয়ে যাবে এই উপহার, এই স্মৃতি। বৃষ্টি কমে এলো কিছু পরে। ততক্ষণে ভিজে গেছি ভালো মতো।

তবে উদ্ভট একটা দৃশ্যও দেখতে হলো এই সময়ে। এক মুসল্লি ভাই, দেখে মনে হলো আমাদের এই উপমহাদেশেরই কেউ হবেন নিশ্চই। পুরো নামাজ চলাকালীন সে বসে থাকলো, নামাজ না পড়ে। বৃষ্টির ফোঁটা যেখানে যেখানে পড়ছে, সেসব ফোঁটায় আঙ্গুল দিয়ে বৃষ্টির পানি নিজের চেহারায় মাখছে। নামাজ শেষে হওয়ার পরও সেই এই কাজই চালিয়ে গেলো অনেক্ষণ। দ্বীনের ক্ষেত্রে আবেগ বেশ উপকারি, এই আবেগের কারণে অনেক বাহ্যত কঠিন কাজও সহজ হয়ে যায়, প্রিয় হয়ে যায়। তবে এই আবেগও হতে হবে শরীয়তের দেখানো সীমার মধ্যে। তা না হলে সেটা আমাদের উল্টো পথে নিয়ে যেতে পারে সহজেই। এজন্যই দ্বীনের উপর চলা শিখতে হবে দ্বীনের বুঝমান আলেমদের থেকে, আল্লাহওয়ালাদের দেখানো পথে। উনারাই দেখিয়ে দিতে পারেন কিভাবে এই আবেগকে কাজে লাগাতে হবে জান্নাতের পথে এগোতে।

দ্বীনের ক্ষেত্রে সঠিক আকিদা, নিয়মনীতি, পদ্ধতি জানা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি আরেকটা জিনিস, যেটা আজকের যমানায় অনেক বেশি দুর্লভ। আর সেটা হলো আদব। দ্বীন সম্পর্কে যাদের এখনো বেশি জানার সুযোগ হয়নি তাদের কথা বাদই দিলাম, খোদ যেসব মানুষদের আমরা দ্বীনদার বলে মনে করি, তাদের ভেতরেও এই আদবের বড় অভাব আজকে। যাদের দিলে আল্লাহর আজমত, তাঁর বড়ত্ব, শ্রেষ্ঠত্বের একীন আছে, আছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি মহব্বত, তারাই পারেন আল্লাহর ঘরের, নবীর রওজার আদব রক্ষা করতে। তাই আদব শিখে নেয়া দরকার আলেমে দ্বীনদের থেকে, আল্লাহওয়ালা বুজুর্গদের থেকে। এসব পবিত্র স্থানে তাদের আদবের নমুনা পেতে আবু তাহের মিসবাহ সাহেবের 'বাইতুল্লার মুসাফিৱ' পড়া যায়। কি অনুভূতি, কি আবেগ, কি শ্রদ্ধা, আদবের প্রতি কি পরিমাণ যত্নশীল হয়ে এসব স্থানে আসেন উনারা।

আর আদবের শিক্ষা না থাকলে কি হতে পারে তা স্বচক্ষে দেখতে হয়েছে আমাকে বহুবার, মক্কা ও মদিনায় ওই অল্প কয়েকদিনে। মসজিদের ভেতরের কথা বাদই দিলাম, একেবারে রওজা পাকের সামনে দাঁড়িয়ে চলছে গল্প, হাসাহাসি। ভিডিও হচ্ছে অনবরত, কেউ আবার সেলফি তুলছেন নবীজির রওজাকে পেছনে রেখে! খুব কষ্ট করে নিজেকে সামলে রাখতাম এসব দেখে দেখে। তবে মদিনা সফরের শেষের দিকের একবার যিয়ারতে একটু বেশি আবেগী হয়ে গিয়েছিলাম। সালাম পেশ করার জন্য এগিয়ে যেতে যেতে দেখতে লাগলাম মানুষের হাতে হাতে মোবাইল, চলছে ভিডিও, সেলফির অত্যাচার। কষ্টটা বাড়তে থাকে যত এগুতে থাকি সামনের দিকে। নবীজির রওজা শরীফের একেবারে কাছে যখন চলে এসেছি, তখন সামনে বেশ কয়েকজনের মোবাইল উঁচু করে ধরা, ছবি উঠছে। নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না আর। চোখ থেকে পানি ঝরতে লাগলো। সামনের ভাইয়েরা অধিকাংশই আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের। ভাঙা হিন্দি-উর্দুতে বলে উঠলাম কান্না নিয়ে, এখানে ছবি না উঠাই, সামনেই আল্লাহর রাসূল শুয়ে আছেন। বন্ধ করুন প্লিজ! আমার সামনেই ছিলেন খুব সম্ভবত পাকিস্তানী এক ভদ্রলোক, আমার চাচাদের বয়সী হবেন। ফটো তুলছিলেন তিনিও। আমার কথা শুনে ফিরে তাকালেন, খুব ঘাবড়ে গিয়েছেন। আমি বললাম, আমাকে ভুল বুঝবেন না। তিনি বললেন, না না, তুমি তো ঠিকই বলেছো! এরকম করা আমাদের উচিত না। খুব তাড়াহুড়ো করে ভদ্রলোক মোবাইলটা পকেটে ঢুকালেন। কিছু মানুষ এখনো আছে যারা সহজে ভুল স্বীকার করতে পারে। তবে এদের সংখ্যা খুব, খুব কম।

এভাবেই কেমন করে যেন চলে এলো বিদায়ের দিন। হায়, এই দিনেরই তো ভয়ে ছিলাম আমি, মদিনায় আমাদের প্লেন নামার পর থেকেই। এই দিনের ভয়েই তো চোখে পানি এসে গিয়েছিলো প্লেনের সিঁড়ি দিয়ে নামার আগে! ভালো সময়, শান্তির সময়, সুখের মুহূর্তগুলো এতো দ্রুত কেন চলে যায়? সময়ের আপেক্ষিকতা কি একেই বলে? মদিনা থেকে যাবো মক্কায়, উমরার জন্য। একদিকে সফরের প্রস্তুতির ব্যস্ততা, অন্যদিকে উমরার জন্য মানসিক প্রস্তুতি, বাইতুল্লাহর তাওয়াফের প্রতীক্ষা, এক্সাইটমেন্ট। তাই মদিনাকে বিদায় বলার কষ্টটা কিছুটা হলেও হয়তো কমে গিয়েছিল, সহনীয় হয়েছিল। মদিনা থেকে রওনা হওয়ার আগে প্রিয় নবীজির রওজায় শেষ যিয়ারতের সময় বাবার সাথে ছিলাম। দুজনেরই চোখ ভেজা! আবার কি আসব? সুযোগ হবে কি? এতো বড় সৌভাগ্য কি আবার আসবে জীবনে? এতো এতো উপহার কি আবারো আমাকে দিবেন আল্লাহ? বাবা মায়ের স্নেহের হাত ধরে, আল্লাহর রহমতের ছায়ায়, আবার কি আসা হবে নবীর মসজিদের মেহমান হয়ে?

আসবো, অবশ্যই আসবো ইনশাআল্লাহ। এই মসজিদে বসে বসে অনেক চেয়েছি এবার, আল্লাহ যেন আবার আনেন, বার বার আনেন, এখানেই যেন রেখে দেন! যেই আল্লাহ না চাইতে এতো দিলেন, তিনি চাইলে কি করে না দিয়ে পারবেন? অবশ্যই দিবেন। দিতেই হবে!


-----------------------------------------------------------------------------------------------------------

লেখাটা যখন পোস্ট করছি, সেই unforgettable উমরার সফরের এক বছরেরও বেশি পার হয়ে গেছে। এবং ইনশাআল্লাহ আর মাত্র চারটি দিন পরেই রওনা হবো আবার! সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ এবছর আবারও ডেকেছেন তাঁর ঘরে, তাঁর বাইতুল্লাহর দরজায়, তাঁর হাবিবের দুয়ারে! উমরাহ নয় শুধু, একেবারে হজ্বের সফর! ইহরাম জড়িয়ে, লাব্বাইক বলে বের হয়ে যাবো ঘর থেকে! সাথে এবার আমার জীবনে নতুন এক মানুষ, আমার স্ত্রী! হজ্বের আহকাম, দ্বীনের শিক্ষা, আমল আর আদব এবার দেখে দেখে শিখবো আমাদের সফরসঙ্গী উলামা হজরতদের থেকে, বিশেষ করে আমার প্রিয় হজরত হামিদুর রহমান স্যারের কাছ থেকে। সুবহানআল্লাহ! আল্লাহর কাছে উপহারের এতো ভান্ডার? আবারো, এতো বড় করে খুলে গেলো আমার সৌভাগ্যের দরজা?  আল্লাহ তুমি অনেক বড়, অনেক প্রিয়, আমাদের তুমি অনেক ভালোবাসো!

বলেছিলাম না, আল্লাহ দিবেন? দিতেই হবে! বিশ্বাস হয় না? একবার চেয়েই দেখুন না চাওয়ার মতো।

বান্দা চাইলে, না দিয়ে তিনি পারবেন?


Comments

Popular posts from this blog

ড: হাসিবের গল্প

ভান করতে থাকো

মন্ত্রমুগ্ধ