নূরের শহরে (২) - উপহারের রাত

আমাদের হোটেলটা ছিল একেবারে মসজিদে নববীর চত্বর ঘেঁষে। মধ্যরাতের পর যখন পৌঁছলাম, এশার নামাজ তখনও বাকি আমাদের। সবাই খুব দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নেমে এলাম। মদিনার ঠান্ডা ঠান্ডা রাতের আবহাওয়ায় এসে দাঁড়ালাম মসজিদের বাইরের সাদা চত্বরে। কতদিন পর আল্লাহ আবার নিয়ে এলেন। ১৫ বছর আগে, তখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি, বাবা মা সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের ৩ ভাই বোনকে। সেই দিনগুলোর কথা ভাবলেই খুব মনে পড়তো এই শুভ্র, শান্তিময় খোলা চত্বরটার কথা। আবারও বাবা মায়ের হাত ধরেই এলাম এবার। আলহামদুলিল্লাহ। এই নিয়ামত আল্লাহ আরও অনেক অনেক বাড়িয়ে দিন। আমিন।


আমাদের ছোট জামাতটার ইমাম হয়ে নামাজ পড়ালাম। হুজুর হুজুর দেখতে হওয়ার কারণে, আর কয়েক পারা মুখস্ত থাকায় প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় নামাজ পড়াতে হয়। এমনকি ঢাকার এক মসজিদেও একবার ফজরের নামাজ পড়ানোর তৌফিক হয়েছিল, কোনো এক ৩ দিনের জামাতে থাকার সময়! কিন্তু এবারের এই নামাজ পড়ানোটাই আমার কাছে সবচেয়ে স্পেশাল ছিল, কারণ এবার দাঁড়িয়ে আছি মসজিদে নবনীর দেয়াল ঘেঁষে! তবে খুশির সাথে ভয়টাই বেশি ছিল সেই সময়। দাঁড়িয়ে আছি কোথায়! এই জায়গায় নামাজ পড়ানো কি, নামাজ পড়তেই তো বুক কাঁপার কথা আমার মতো মানুষের। মানুষকে নাহয় ধোঁকা দিয়েছি দাড়ি আর টুপি দিয়ে, বড় বড় নসিহত দিয়ে। আল্লাহ তো জানেন, ভেতরের খবর! আল্লাহ মাফ করুন, কবুল করুন। 

বাবা মা সহ আমদের সাথের বাকি ৩ জনেরও বয়স যথেষ্ট। বিশেষ করে বাবা মা সারাদিনের সফরের পরে একেবারেই ক্লান্ত তখন। ওই সময় তাদের সবচেয়ে প্রয়োজন ভালো একটা রেস্ট। ফজরেও তো উঠতে হবে। তাই সবাই ঠিক করলেন হোটেলে ফিরে যাবেন। যিয়ারতের জন্য অনেক হাটা প্রয়োজন, সেই শক্তি কারো শরীরেই নেই তাদের, থাকার কথাও না। কিন্তু আমি? মসজিদে নববীর দরজা থেকে ফিরে যাবো ভেতরে না ঢুকেই? আমার কি এতটা ক্লান্তি আসার কথা ত্রিশ বছর বয়সে? মসজিদের দালানের অপর প্রান্তেই তো শুয়ে আছেন আমার নবী (স) । যদি প্রশ্ন করে বসেন যখন দেখা হবে, কিরে, সেদিন এতো কাছে এসেও ঘুমুতে চলে গেলি? সালাম দিয়ে গেলি না? আমার চেহারা তুই দেখবি না অবশ্য, কিন্তু আমি তো তোর চেহারাটা দেখতাম! তোর হাসি আর কান্না মাখা মুখটা দেখতাম। তোর সালামের জবাব দিতাম! 

বাবা মা-কে জানালাম, আমি তো যিয়ারত না করে যেতে পারছি না। উনারাও সেরকমই এক্সপেক্ট করেছিলেন বোধহয়। বাবাই দেখিয়ে দিল 'বাবুস সালাম ' এর রাস্তা। আল্লাহ তার জান্নাতের রাস্তা সহজ করুন।

মসজিদের বাইরের সাদা চত্বর তখন অনেকটাই ফাঁকা, হালকা সাদা আলোয় আলোকিত। তবে দূর থেকে যখন বাবুস সালামের খোলা দরজাটা চোখে পড়লো, ভেতরের সোনালী আলো যেন ঠিকরে বের হয়ে আসছে। বাইরের রাতের আলোয় মসজিদের চত্বর আর দেয়ালের মাঝে, সেই খোলা দরজাটা থেকে যেন উপচে পড়ছে সোনালী আলো! আমার মতো সাধারণের চোখে তো কেবল ভেতরের ঝলমলে ঝাড়বাতির আলোই চোখে পড়ে, তবে আল্লাহর প্রিয় বান্দারা নিশ্চয়ই অন্য কোনো আলো দেখতে পান! নিশ্চয়ই!

মসজিদের এই গেটে সবসময় মানুষের স্রোত। এই গভীর রাতেও তার ব্যতিক্রম নেই। মানুষের স্রোত চলছে সামনের দিকে, যত সামনে আগাচ্ছি, চাপ ততই বাড়ছে। হবারই তো কথা। প্রিয় হাবিব মুহাম্মদ (স) তো মাত্র কয়েক কদম দূরেই! উনাকে সালাম জানানোর এই মিছিল চলছে, চলবেই। যতদিন দুনিয়াতে থাকবে তাঁর অনুসারীরা, তাঁকে মহব্বতকারীরা।

ধীরে ধীরে কাছে চলে আসছে পবিত্র রওজা মুবারাক। অল্প কিছু সামনেই সবুজ-সোনালী জালি। আরও কিছু পা, আরও একটু কাছে। আশেপাশের প্রতিটা মানুষের মুখে তখন দরূদ ও সালামের ধ্বনি, সেই সাথে কান্নার আওয়াজ। দরূদ, দুআ আর কান্না মিলে একটা মৃদু গুঞ্জন। কারো কান্না চাপা, কারওটা জোরে, আর কারওটা বাঁধ ভাঙা! আর আমারটা?

নবীজির রওজা চলে এলো। মানুষের স্রোত অনবরত লেগে থাকার কারণে এখানে দাঁড়াতে দেয়া হয় না বললেই চলে। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম প্রিয় হাবিবকে, ভেজা চোঁখে। সালাম দিলাম তাঁর দুই প্রাণ প্রিয় সঙ্গীকেও। সে সময়ের অনুভূতির বর্ণনা দিতে যাচ্ছি না, দিতে পারবোও না। আবেগ প্রকাশের সে পরিমান দক্ষতা আমার নেই। শুধু বলবো সালাম শেষে দরজা দিয়ে যখন বেরিয়ে আসছি, দুচোখ দিয়ে পানি ঝরছিল। এতুটুকু পানি ঝরাতে পারাও আল্লাহর নেয়ামত, অনেক বড় নেয়ামত আমার মতো অযোগ্য বান্দার জন্য। 

যিয়ারত করে হোটেলে ফিরে যাওয়ার অলস নিয়ত ছিল, কিন্তু 'দিল' মানলো না, জোর করে আবার ঢুকিয়ে দিলো মসজিদে, একই পথে। কিছুদূর আগাতে দেখি এক জায়গায় অনেক মানুষের জটলা, সবাই যেন সামনের দিকে কোথাও যেতে চাচ্ছে। কিন্তু সেটা তো যিয়ারতের লাইন নয়। একটু পরে বুঝতে পারলাম। মসজিদে নববীর মিম্বার আর রওজার মাঝের অংশটাকে প্রিয় নবী (স) জান্নাতের টুকরা বলে গেছেন। এই জায়গাকে 'রিয়াদুল জান্নাহ' বলে। জান্নাতের বাগান। এখানে দু রাকাত নামাজ পড়ার জন্য, একটু হাত উঠিয়ে দুআ করার জন্য মানুষের ভিড় লেগেই থাকে সারাক্ষণ। রাত তখন দুটারও বেশি বাজে বোধহয়। এখনও কত মানুষ! কি মনে হলো জানিনা, মানুষের ভিড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে গেলাম।

খুব ধীর গতিতে এগোচ্ছে বান্দাদের স্রোত। রিয়াদুল জান্নাহর সীমানা কোনো দেয়াল দিয়ে ঘেরা না, খোলাই। তবে চিহ্নিত করা আছে কার্পেটের ভিন্ন রং দিয়ে। মসজিদের বাকি সব অংশের কার্পেট লাল, এই ছোট অংশটা সবুজ, তার উপরে সাদা বা ক্রীম কালারের কাজ। যারা সুযোগ পাচ্ছে ভেতরে একটু নামাজ পড়ার, তারা খুব সহজে জায়গা ছাড়তে চায় না। আর না ছাড়লে পেছনের বেচারারাও সুযোগ পায়না। এজন্যই এই ধীর গতি। তবুও এগোতে লাগলাম অল্প অল্প করে। এভাবেই প্রায় আধা ঘন্টা পার হয়ে গেলো।

বামপাশে তাকিয়ে দেখলাম রাসূল (স) এর রওজার দেয়াল একসময় প্রায় বরাবর এসে গেলো। আরও এগোলাম, খুব ধীরে। মুখে কেবল দরূদ পরে যাচ্ছি। হঠাৎ পায়ের নিচে তাকাতেই দেখি, লাল কার্পেট নেই, সবুজ! আমি ঢুকে গেছি জান্নাতের বাগানে! খুব দ্রুত একটু খানি জায়গা পেয়ে গেলাম। মসজিদের মুয়াযযিন সাহেবের আযান দেয়ার একটা উঁচু প্ল্যাটফর্ম আছে, আমি জায়গায় পেলাম এই প্ল্যাটফর্মের পিলার ঘেঁষে। দুই রাকাত নামাজ পড়লাম, বেশি সময় না নিয়ে। দুআ করলাম হাত তুলে, সেটাতেও খুব দেরি করলাম না। এই পবিত্র জায়গায় এসে কে উঠে যেতে চায়? কে চায় নামাজকে, দুআকে সংক্ষিপ্ত করতে? কিন্তু ওই আমার বামপাশে যিনি শুয়ে আছেন, যার মহব্বতে এখানে ছুটে আসা, উনিই তো বলেছেন, ভাইয়ের জন্য তাই ভালোবাসো, যা নিজের জন্য ভালোবাসো! আমার কত ভাইয়েরা দাঁড়িয়ে আছে বাইরে, অধীর অপেক্ষায়। এই একটু সুযোগের জন্য। আমি একটু আগেই ছিলাম তাদের স্থানে, আমি জানি তাদের দিলের অবস্থা। তাই মনের তীব্র ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও, বসে থাকলাম না, আর নামাজের নিয়ত করলাম না। উঠে দাঁড়ালাম বেরিয়ে গিয়ে আরেকজনকে সুযোগ করে দেয়ার জন্য।

কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা যে ভিন্ন ছিল, সেটা আমার কল্পনাতেও ছিল না!

দাঁড়ানোর সাথে সাথেই শুরু হলো আযান! সুবহানাল্লাহ! কি সুন্দর, অপার্থিব আযান ! কিন্তু এখনও তো ফজরের অনেক বাকি, তবে এটা কিসের আযান? বুঝতে পারলাম একটু পরেই, এটা 'কিয়ামুল লাইল' বা তাহাজ্জুদের আযান। আরও আশ্চর্য হলাম এই দেখে রিয়াদুল জান্নাতের প্রবেশ পথগুলো আটকে দেয়া হলো, বাইরে থেকে আর কেউ ঢুকবে না। আজানের সাথে সাথে রিয়াদুল জান্নাতে আর ঢোকা যায় না, চাইলে বের হওয়া যায়। তারমানে এখন বেশ কিছুক্ষনের জন্য 'জান্নাতের টুকরার' এই ছোট জায়গাটা আমার, কেউ বের করে দিবে না! নিজের সৌভাগ্য বিশ্বাস করতেও বেশ কিছুক্ষন সময় লেগে গেলো। ঘোর কাটতেই জামাত দাঁড়িয়ে গেলো কিয়ামুল লাইলের জন্য।

তিলাওয়াত শুরু হতেই পেয়ে গেলাম আরও একটা উপহার। ছোট বেলা থেকে যাদের তিলাওয়াত মনের মধ্যে গেথে আছে, অনেক নতুন জনপ্রিয় ক্বারীদের ছাপিয়ে যাদের তিলাওয়াতই বারবার শুনতে থাকি, আমার কাছে সেরকম একজন প্রিয় ক্বারী হলেন মসজিদে নববীর প্রবীণ ইমাম, আলী আব্দুর রহমান আল হুযাইফী। মনে মনে খুব ইচ্ছা ছিল, এবার যেন মদিনায় উনার নামাজ পাই। আর সেটা পেয়ে গেলাম একেবারে প্রথম থেকেই! সেই পরিচিত আওয়াজ কানে আসতেই কান্না এসে পড়লো। কত গাম্ভীর্যপূর্ণ সেই তিলাওয়াত, কত স্পষ্ট মাখরাজ, কতটা নিখুঁত, consistent তাজবীদ। সত্যিই বলেন আল্লাহওয়ালারা, মক্কা-মদিনায় এসে, এরকম দু'রাকাত নামাজ পড়লে, মনে হয় যা কিছু খরচ হয়েছে সব উসুল। মুগ্ধতায় উপভোগ করলাম সেই নামাজ।

কিয়ামুল লাইল শেষ হলো, ফজরের আজানের তখনও কিছু সময় বাকি। ভাবছিলাম এখন বোধহয় ছেড়ে দিতে হবে জায়গা। কিন্তু না, কারও কোনো মুভমেন্ট দেখতে পেলাম না। বুঝলাম, জান্নাতের বাগানে থাকার সৌভাগ্য আরো বর্ধিত হচ্ছে। দুআয় লেগে গেলাম এবার, মন খুলে, প্রাণ ভরে দুআ করতে লাগলাম। এর মধ্যেই আজান পড়লো ফজরের। নামাজের জন্য দাঁড়িয়ে গেলো সবাই। ফজরের জামাতে আবারো কারী হুযাইফীর তিলাওয়াত, আবারও কান্না, আবারও মুগ্ধতা।

সব সুন্দর সময় শেষ হবেই দুনিয়ার জীবনে। আল্লাহর প্রতি এই দুই ঘন্টার জন্য যতই কৃতজ্ঞতা জানাই, সেটা যথেষ্ট হবে না কখনোই। আলহামদুলিল্লাহ বলতে বলতে সামনের দিকে দিয়ে বের হয়ে এলাম রিয়াদুল জান্নাহ থেকে। প্রিয় নবীজির যিয়ারত, রিয়াদুল জান্নাতে অপ্রত্যাশিত দীর্ঘ এই সুযোগ, সব মিলে এই রাতটা ছিল একটা স্বপ্নময় রাত। নবীর দরজায় অভ্যর্থনার, উপহারের রাত।


---------------------------------------------------------------------------------------------------------------

হোটেলে ফিরে এসে বেশিক্ষণ ঘুমানোর সময় পাইনি, নাস্তার সময় হয়ে গিয়েছিলো। আমার রুমমেট ছোট ফুপা টের পেয়েছেন আমি সারা রাত রুমে আসিনি। সেই সুবাদে বাবা মা-ও জেনে গেছে। নাস্তার টেবিলে তাই তারা একটু থমথমে। চিন্তিত, এই ছেলে যে এই কয়দিন আর কত কি পাগলামি করবে!

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

Sylhet 2009 (Day 3): The Other Side of the Fence

মন্ত্রমুগ্ধ

AUSTronics goes public !