মায়ের শিক্ষা

বাবার জীবনের অনেক বড় একটা অংশ কেটেছে কষ্টে। দাদার বারবার বদলি হওয়ার কারণে কিছুদিন পর পর বাবার স্কুল বদলাত। মহা গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস নাইনে তার স্কুল বদলেছে তিন বার! তার মধ্যে নতুন নতুন স্কুলে না আছে বন্ধু, না আছে supportive শিক্ষক। নতুন স্কুলের ক্লাসমেটরা সবসময়ই বাঁকা চোখে দেখতো, টিটকারি করতো। পড়াশোনায় সাহায্য করা তো দূরের কথা। এমনকি শিক্ষকরাও নতুন ছাত্রকে ছোট করে দেখতো। সুযোগ পেলেই তাকে একটু খোঁচা মারা। ক্লাসে পড়া ধরতে হলে আগেই বাবাকে ধরতো, আর না পারলেই শুরু হতো খোঁচা। অথচ তার পুরোনো ছাত্ররাও যে পারছে তা না। কিন্তু সব দোষ শুধু বেচারা নতুন স্টুডেন্টের
  
সেই সাথে পরিবারে টানাটানি, দায় দায়িত্ব তো আছেই। বাবার বেড়ে ওঠার গল্পটা একটা আলাদা ইতিহাস, সেটা নিয়ে বলতে গেলে এতো ছোট লেখায় হবে না, বই লেখার প্রজেক্ট নিতে হবে। 

আল্লাহর ইচ্ছায় একসময় সে বাবা ডেন্টিস্ট হল। পোস্ট গ্রাডুয়েশনও করলো বিলেতে। দেশে ফিরে আসার পর সেই হল গোটা বাংলাদেশের এক মাত্র বিদেশি ডিগ্রিধারী ডেন্টিস্ট। তাই উপর মহলে তার নাম ডাক প্রচার হয়ে গেলো। দেশের ‘বড় বড়’ মানুষরা তার কাছে দাঁত দেখাতো। শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, আমলারা, এমনকি, সেনা, বিমান বাহিনীর কর্তারা পর্যন্ত। যে ছেলেটা বছর দশেক আগে কলেজের ক্লাস শেষে বুড়িগঙ্গার তীরে বসে নদীর পানিতে কাপড় কাচত, কত অপমান সহ্য করে ‘অন্যের’ বাড়িতে আশ্রিতের মত থেকে, ফাই ফরমাশ খাটতো, তাকে আজ নৌবাহিনীর প্রধান নিজের গাড়ি পাঠিয়ে অনুরোধ করে ডেকে নিচ্ছে নৌবাহিনীর সদর দপ্তরে, নিজের অফিসে দাঁত দেখাবে বলে। কারণ সে দেশের সেরা চিকিৎসককেই দেখাবে। আল্লাহর ইচ্ছা, সকল কাজে  sincerity, আর সকল প্রতিকূলতার মধ্যেও হাল না ছাড়া ডেডিকেশন তাঁকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে এসেছে। সুবহানাল্লাহ 

ডাক্তারি পেশার সুবাদে এভাবেই তার তৎকালীন সমাজের শীর্ষস্থানীয় বেশ কিছু মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরী হয়। কিন্তু এত এত strong link থাকার পরেও বাবা কখনই এই link গুলোকে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক স্বার্থের জন্য কাজে লাগানর চেষ্টা করেনি, যেটা করা খুবই স্বাভাবিক ছিল। অনেক টাকা, অনেক সম্পত্তি, অনেক পাওয়ারের প্রতি লোভটা তার তখনও একেবারেই ছিল নাকোনোদিন হয়ওনি। বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, তখনও তো তুমি এতটা দ্বীন-ইসলামের  বুঝ সমঝ পাওনি, যেটা পরে আল্লাহ তোমাকে দিয়েছেন। তাহলে সেই সময় তুমি কিভাবে এতটা নির্লোভ ছিলে? কেন এত বড় বড় মানুষের সাথে পরিচয়কে, নিজের উপরে উঠার জন্য কাজে লাগাতে চাও নি? 

বাবার উত্তর, এই মানসিকতার পেছনে তার মায়ের, অর্থাৎ আমার দাদির ভূমিকাই বেশি। আমার দাদি কখনই তাকে লোভ শেখান নি, বিত্ত বৈভবের পেছনে ছোটা শেখাননি। তিনি বাবাকে পড়াশোনা করার প্রতি উৎসাহী করেছেন। বাবা আর দাদির ambition ছিল যে বাবা উচ্চ শিক্ষা অর্জন করবে। কিন্তু সেটা আসলেই শিক্ষিত হবার জন্য, মানুষ হবার জন্য। বড়লোক হবার জন্য না।  
অথচ খুব আশ্চর্য ব্যপার হল, এই দাদির কিন্তু উল্টোটাই চাওয়ার কথা। দাদার সংসারে এতগুলো বাচ্চা নিয়ে সারাজীবন তার কেটেছে কষ্টে, টানাটানিতে। ছেলেকে এত উচ্চ শিক্ষিত করে, ছেলেকে সে শেখাতেই পারত, যা পারিস কামিয়ে নে। আমি, আমরা যে কষ্ট করেছি, সেই কষ্ট যেন কোনদিন আর আমাদের, আমাদের নাতিপুতিদের স্পর্শ না করে, সেই ব্যবস্থা কর। সেটা বলাটাই কি স্বাভাবিক ছিল না? কিন্তু দাদী তা করেন নি। বরং ছেলেকে উন্নতির এই শিখরে দেখেও অহংকার থেকে, লোভ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।

বাবার সাথে এই আলোচনার পরে মনে পড়ে গেল বেশ কিছুদিন আগে কোনো এক দ্বীনি প্রোগ্রামে শোনা একটা কথা। আমাদের কোন আলেমের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আচ্ছা, আগের সময় কত বড় মাপের মানুষ তৈরি হয়েছে, কত জ্ঞানীগুণী। তারা তাদের অমূল্য সাধনা আমাদের জন্য রেখে গেছেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে। আমরা তাদের সেই জ্ঞানের উপরই এখনও ভরসা করে যাচ্ছি। এখন তো আরও কত বড় বড় স্কুল কলেজ ভার্সিটি হয়েছে, কত সুবিশাল সব দীনি প্রতিষ্ঠান, আর সেগুলোতে আগের চেয়ে কত বেশি ছাত্র ছাত্রী, আর তাদের কত সুযোগ সুবিধা। কিন্তু কই, তাদের থেকে তো সেরকম বড় মাপের জ্ঞানী তৈরি হচ্ছে না। সমাজের, মানুষের সেরকম খেদমত পাওয়া যাচ্ছে না। এর জবাবে সেই আলেম বলেছিলেন, আপনি তাদের বাবা-মাদের দেখুন  তারা কিরকম মানুষদের হাতে, কেমন পরিবারে বড় হয়েছিলেন। কেমন ছিল তাদের ঘরের পরিবেশ, ঘরের শিক্ষা। আর আমাদের বাচ্চারা বড় হচ্ছে আমার আপনার মত মানুষের হাতে! পার্থক্য তো হবেই! 

শায়খ জুলফিকার আহমেদের একটা কথা বারবার মনে পড়ে, এখানেও মনে পড়ল। স্কুল কলেজ মাদ্রাসায়  হয়ত জ্ঞানী, বিজ্ঞানী, আলেম তৈরী হয়। কিন্তু মানুষ তৈরি হয় ঘরে। বাবা-মায়ের হাতে।   

Comments

Popular posts from this blog

নূরের শহরে (২) - উপহারের রাত

The Sundarbans 2009 - Part 4: The Prolonged Ending

Sylhet 2009 (Day 3): The Other Side of the Fence