বৃষ্টির জলে ভেসে বেড়াই

[লেখাটা বৃষ্টি নিয়ে, তাই ব্যাকগ্রাউন্ডে বৃষ্টির সুর থাকলে মনে হয়ে মন্দ হয় না, কি বলেন? 
তাহলে হেডফোন লাগিয়ে ,পাশের প্লে বাটনে ক্লিক করুন ! সাথে এক চা হলে আরও ভালো ]



এশার নামাজে যাওয়ার সময় বৃষ্টি ছিল না। বৃষ্টির লক্ষণ ছিল, তবে লক্ষ্য করার সময় ছিল না। নামাজের মধ্যেই ঝিরঝির শব্দ পেলাম। বুঝলাম, আজ বাসায় ফিরতে দেরি হতে পারে। 


আয় বৃষ্টি ঝেপে...

নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হওয়ার জন্য আমাদের মুসল্লিদের বড় অংশের মধ্যেই প্রচন্ড একটা তাড়া থাকে। কবি আমাদের অন্তরের কথা জানতে পারলে হয়তো লিখতেন,

অস্থিরতা বৃদ্ধি পাইতেছে, অন্তর জ্বলিয়া যাইতেছে,
মসজিদের ভেতর যে আটকা, সে কি করিয়া শান্ত হইতে পারে ....


As expected, নামাজ শেষে মসজিদের গেটের কাছে এসে দেখি অনেক অস্থির মুসল্লিদের ভিড়, বেরোতে পারছে না। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। আটকে পড়া ভাইয়েরা অসহায় দৃষ্টিতে বৃষ্টি দেখছে। গেটের সামনে দোতলায় উঠার প্রশস্ত সিঁড়ি। আমি কয়েক ধাপ উপরে উঠে বসে পড়লাম, ঠিক স্টেডিয়াম বা সিনেপ্লেক্সের গ্যালারিতে বসার মতো। কারণ বৃষ্টি আমার কাছে একটা enjoyable জিনিস, একটা Source of entertainment । তবে রাতের বেলায় বৃষ্টি দেখা যায়না। গাড়ির আলোর সামনে কেবল বৃষ্টির ধারাটা দেখা যায়, ল্যাম্পপোস্টের বাতিটার ঠিক নিচের কিছু ফোটা দেখা যায়, পিচ ঢালা রাস্তায় পড়তে থাকা ফোটাগুলো দেখা যায়। তবে আমি এখন বৃষ্টি দেখতে চাচ্ছিনা। আমি চাচ্ছি বৃষ্টি শুনতে, বৃষ্টি শুঁকতে। বৃষ্টির দৃশ্য, গন্ধ, শব্দ, সবই উপভোগ করার জিনিস।

তাই মসজিদের 'গ্যালারিতে' বসে আমি চোখ বন্ধ করলাম….




বৃষ্টির রূপ সব জায়গায় এক না। নদীর তীর, বা গহীন বনের প্রাকৃতিক পরিবেশে বৃষ্টির চেহারা একরকম, আর ব্যস্ত শহরের রাস্তায় নামা বৃষ্টির সিনারি সম্পূর্ণ আরেকরকম। এখানে বৃষ্টির সাথে থাকে বৃষ্টিতে পড়া মানুষের মধ্যে নানান গোছের চরিত্র। পথচারীদের অধিকাংশ কোনো না কোনো দোকানের সামনে ফুটপাথের সরু অংশে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ কেউ আবার দোকান বা মার্কেটের ভেতরে ঢুকে পড়বে। দোকানে মানুষ আসলে দোকানদারের খুশি হবার কথা, তবে এদের দেখে মোটেই খুশি হয়না। কারণ এরা শুধুই টাইম পাস করবে, বৃষ্টি ভেজা হাতে এটা ওটা নেড়েচেড়ে দেখবে, দাম জিজ্ঞেস করবে, জুতার কাদা দিয়ে ফ্লোর নোংরা করবে। দোকানদারদের সম্ভবত ইচ্ছা করে এদের উপর একটা নির্দিষ্ট মূল্যের পণ্য কেনা বাধ্যতামূলক করতে। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে চাইলে কিছু কিনতে হবে, এমনি এমনি ঢোকা যাবে না।


যেসব শিশুদের ঠিকানা রাস্তা, বৃষ্টি বোধহয় তাদের জন্যই সবচেয়ে আনন্দের। এরা একেবারেই অকারণে একজন আরেকজনের পিছনে দৌড়াতে থাকবে, টানাটানি করবে, নিজেদেরই কোন একটা পিচ্চিকে টেনে ফেলে দেবে, জমে থাকা পানিতে লাফাবে। আর তাদের মুখে থাকবে একশোভাগ ভেজালমুক্ত এক ফালি হাসি। 

বৃষ্টি দেখার জন্য কিন্তু ওভারব্রিজগুলো দারুণ !

কিছু অতি সাবধানি লোক যারা বছরের ৩৬৫ দিনই ছাতা সাথে রাখে, তারা আজকে তৃপ্তির হাসি নিয়ে বুক ফুলিয়ে হেটে যাবে আটকে পড়া লোকদের সামনে দিয়ে। এছাড়া কিছু কবি, ভাবুক টাইপ ভার্সিটির ছাত্র জিন্সের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বিকারহীন ভাবে ভিজে ভিজে হাটবে। সব মানুষ বৃষ্টিতে ছাতা ছাড়া ভিজতে ভিজতে হাটবে, এটাই যেন জগতের স্বাভাবিক নিয়ম। এই শেষোক্ত দুই প্রজাতির উপর বাকিরা সবাই চরম বিরক্ত। সেটাই স্বাভাবিক।




প্রাকৃতিক পরিবেশে বৃষ্টিতেও অবশ্য অনেক চরিত্র থাকে, তবে তাদের এতো সহজে দেখা যায়না। দেখা গেলেও, তাদের অনুভূতি খুব কম মানুষই বোঝার ক্ষমতা রাখে। প্রকৃতির মাঝে বৃষ্টি উপভোগ করার সুযোগও আমার হয়েছে অনেক। মালয়েশিয়ায় পড়ালেখা জীবনে বেশ কিছু মাস পার করেছি যে হোস্টেলে, সেটা ক্যাম্পাসের একেবারে প্রান্তে। হোস্টেলের বারান্দায় দাঁড়ালে মনে হয় পাহাড়ি এলাকায় কোনো রিসোর্টে এসেছি। চোখের সামনে সবুজ আর সবুজ। বিল্ডিংয়ের দেয়াল ঘেষে শুরু ঘাসের সবুজ, তারপর বিস্ত্রিত পাম গাছের বন, আর তার ওপারে গাঢ় সবুজ জঙ্গলে মোড়া পাহাড়। আর মাথার উপর বিশাল আকাশ। এই আকাশটা যে এত বড়, এতো প্রশস্ত, এটা এই ক্যাম্পাসে না আসলে মনে হয় বুঝতাম না। এখানে বিল্ডিংগুলো এমনিতেই ছোটছোট, তাও আবার অনেক দূরে দূরে। তাই আকাশটা তার সমস্ত সুবিশাল সৌন্দর্য নিয়ে সবসময় দেখা যায়। উপরে না তাকালেও দেখা যায়। মেঘ না থাকলে এই আকাশ আশ্চর্য রকম ঝকঝকে একটা নীল, তার মধ্যে যখন সাদা মেঘগুলো ভাসে, চোখ সরানো যায়না। আর ধুলোবালি না থাকার কারণে কিনা জানিনা, ওখানে আকাশটাকে কেন যেন অনেক বেশি কাছে মনে হয়। যেন কয়েকতলা দালানের ছাদে উঠলেই ধরা যাবে।


নীল, সাদা, সবুজ

এই আকাশ মেঘে ভর্তি হতে, বৃষ্টি ঝরাতে কোনো সময় নেয় না এখানে। আর এই বৃষ্টির সময়টাই আমি সবচেয়ে এনজয় করতাম। হোস্টেলের ঐ বারান্দায় দাঁড়িয়ে কত যে বৃষ্টি দেখেছি তার হিসাব নেই। কখনো বৃষ্টি নামতো শান্তভাবে। এই বৃষ্টিতে গাছপালা আর পাহাড়গুলোকেও বেশ শান্ত আর শান্তিময় মনে হতো। পাখিদের দেখতাম পাতার ছায়ায় চুপচাপ বসে আছে। পাতা দিয়ে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে পারছে না, বাঁচার চেষ্টাও করছে না। পরিচিত বানরগুলোও ভিজছে। দুষ্টু টাইপের পিচ্চি বানরগুলো সবসময়ই লাফায়, এই বৃষ্টি সেটা আরও বাড়িয়ে দেয়। তবে কয়েকটা বেশি ছোট বা ভীতু টাইপের বাচ্চা মায়ের বুক জাপটে ধরে ঝুলে থাকে। মানুষ আর বানর খুব লাকি প্রজাতি, এরা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মাকে জাপটে ধরতে পারে।

তবে কখনো সেখানে বৃষ্টি নামতো প্রচন্ড একটা রূপ নিয়ে। সেটা হঠাৎ করে আসতো না। এই বৃষ্টির আগমনের অনেক প্রস্তুতি। নীল আকাশ আস্তে আস্তে কালো হতে থাকে। রাগী চেহারার মেঘগুলো জড়ো হতে থাকে স্তরে স্তরে। মেঘের লেয়ার যত বাড়ে, ততো আকাশ কালো হতে থাকে। কখনো একেবারে ভর দুপুরে আলো কমে যায় এতটাই, যে মনে হয় মাগরিব এর ওয়াক্তের একেবারে শেষ সময়। প্রস্তুতি চলে বাতাসেও, তবে সেটা আবার সবসময় এক রকম না। কখনো দমকা বাতাসে জানালাগুলো ভেঙে যেতে চায়, বারান্দায় শুকাতে দেয়া পাঞ্জাবীগুলো উড়ে ঢুকে পড়ে করিডোরে। আবার কখনো ঠিক উল্টো, বাতাস একেবারে থেমে যায়। গাছগুলো থম মেরে যায় ভয়ে। দুষ্টমতি বানর পিচ্চিগুলোকে জোর করে ধরে নিয়ে মায়েরা কোথায় যেন চলে গেছে। পাখিদেরও কোনো চিহ্ন নেই কোথাও। ওদের কি কোনো ইমার্জেন্সি শেল্টার আছে? আমাদের যেমন থাকে বন্যার সময়?

আকাশ ফেটে পড়ার অপেক্ষায়

এমন সময় ফোটা পড়া শুরু করে, এক দুই ফোটা করে। বাড়তে থাকে বৃষ্টি, বাড়তে থাকে, বাড়তেই থাকে। বৃষ্টি বেড়ে কোন পর্যন্ত যেতে পারে, সে সম্পর্কে পূর্বের সব ধারণা ভেঙে দিয়ে বৃষ্টি আরো বাড়তে থাকে! পানির ধারা যেন ঘোলা কোনো পর্দা, আকাশ থেকে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই সাথে বাতাসের সাথে ভেসে আসে পানির ফোয়ারা। কোনো ছাতা, কোন ছাদ এই বৃষ্টি থেকে বাঁচাবে না। ভিজিয়েই ছাড়বে। এরকম প্রতাপশালী বৃষ্টি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়না, সেটা ভেবে থাকলেও ভুল হবে। বৃষ্টির ট্যাংকি যেন খালিই হয়না। ঘন্টার পর ঘন্টা চলতেই থাকে।

বৃষ্টি শেষেও চমকের শেষ নেই। আকাশ পরিষ্কার হতে হতেই, সামান্য দূরের ঐ পাহাড়ি বনে দেখা যায় আরেক আজব দৃশ্য। সবুজের ফাঁকে ফাঁকে, এখানে ওখানে মেঘের মতো ধোঁয়া উঠছে। আকাশ থেকে নামা পানি আবার দল বেঁধে আকাশে চলে যাচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে দেখতাম বৃষ্টির আকাশে ফিরে যাওয়া।



আমি সবসময়ই শব্দের দ্বারা অনেক বেশি influenced হই। কর্কশ, বিকট আওয়াজ যেমন মেজাজ খারাপ করে দেয়, ঠিক তেমনি সুন্দর কোনো শব্দও মুহূর্তের মধ্যে আমার মন ভালো করে দিতে পারে। মনের উপর শব্দের ইফেক্টের এই বেপারটা বেশিরভাগ মানুষই ঠিক বুঝে না, অথবা পাত্তা দেয় না। আমার ধারণা ঢাকাবাসীরা বিশেষ করে শব্দের প্রভাব থেকে desensitized হয়ে গেছে ছোটবেলাতেই। শব্দ দূষণ আমাদের কানকে পঁচিয়ে দিয়েছে। তবে কোনো কারণে আমার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। সেকারণে সুবিধা অসুবিধা দুটাই হয়েছে। অসুবিধা হলো, বাসে উঠতে হয় অলমোস্ট প্রতিদিনই। সেখানে টিকে থাকার জন্য প্রায় সবসময়ই আমার কানে হেডফোন থাকে। আর সুবিধা? আমি প্রকৃতির শব্দ, বিশেষ করে বৃষ্টির শব্দ সম্মোহিতের মতো শুনতে পারি। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে শুধু দেখিইনা, চোখ বন্ধ করে শুনি পানির কুলকুল। গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে শুনি পাতার ঝিরঝির। প্রতিটা পাখির গান আলাদা করে ফেলি ওদের সম্মিলিত কোরাস থেকে। ঐযে বললাম বাসে বসে হেডফোন কানে দেই, কি চলে সেখানে? কখনো বৃষ্টির, কখনো লেকের পাড়ের, কখনো বনের ভেতরের ‘সুর’।

আর এই শব্দের দুনিয়ায় শহরের বৃষ্টি প্রকৃতির চেয়ে অনেক এগিয়ে, অন্তত আমার অভিজ্ঞতায়। হোস্টেল থেকে প্রাকৃতিক এলিমেন্টগুলো কিছুটা দূরে হওয়ায়, সেখানে বৃষ্টির শব্দে কেবল একটাই বাদ্য বাজতো, গাছের পাতায়, বা ঘাসের উপর ফোটা পড়ার শব্দ। কিন্তু শহরে বৃষ্টির সুরে instruments এর অভাব নেই! বৃষ্টির একটা বড় অংশ পড়ে পিচঢালা পথে, ঝিরঝির করে এক নাগারে। এটাই মূল Rhythm। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা বড়লোকের গাড়ির মোটা গ্লাসে বৃষ্টি পড়ছে ভারী স্বরে, পড়-পড়, পড়-পড়...। টং দোকানের টিনের চাল বাজাচ্ছে টুং-টাং ধ্বনি, আবার চালের ফুটোর নিচে পেতে রাখা ফাঁটা বালতিতে পড়ছে টুপ-টাপ! রাস্তায় ফেলে রাখা সিগারেটের প্যাকেটটাও চুপ করে নেই, পট-পট  করছে। পাশের পাঁচতলা বাড়ির ছাদের পানি পাইপ দিয়ে ছের-ছের  টাইপের একটা শব্দ করে পড়ছে ফুটপাথের মাঝখানে। নদী না থাকলেও কুলকুল  শোনা যাচ্ছে, রাস্তা ঘেঁষে বয়ে যাওয়া ড্রেন থেকে!

আহা কি আনন্দ.....

এসব চরিত্রের নাটক দেখার জন্য, এতসব বাদ্যযন্ত্রের composition শুনার জন্য অবশ্য আমার মতো বেকার মানুষ লাগে। সবাই তো আর বেকার না! তবে একদিন হোস্টেলে আমার পাকিস্তানি রুমমেট আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, বৃষ্টির শব্দ শুনতে শহরেই বেশি মজা, অনেক রকম সাউন্ড পাওয়া যায়। আজব তো! আমার মতো তারমানে অনেকেই ভাবে? নিজেকে unique একজন, সবার থেকে আলাদা কিছু একটা ভাবতে যতই ভালো লাগুক, আসলে আমরা কেউই তা না। অনেকেই আছে আমার মতই, অথচ কেউই ঠিক আমি না! বেপারটা কিছুটা দুঃখজনক, এবং একই সাথে ইন্টারেস্টিং।




দেখুন অবস্থা! ছিলাম বসে সেই মসজিদের সিঁড়িতে, চলে গেলাম কত দূর-দূরান্তে, বৃষ্টির পিছে পিছে। এই বৃষ্টি জিনিসটাই এমন, সবসময় আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, মোহাবিষ্ট করে রাখে। আমি সময়, স্থান ভুলে যাই। Norms ভুলে যাই। সেদিনও ভুলে গিয়েছিলাম। তাই ১৫ মিনিট বসে থেকে বৃষ্টির মধ্যেই নেমে পড়েছিলাম রাস্তায়। দাড়ি, টুপি, পাঞ্জাবি পড়া হুজুর পিঠে ব্যাকপ্যাক নিয়ে রাস্তায় রাতের বৃষ্টিতে হাসি-হাসি মুখ করে ভিজছে, এই দৃশ্যটা অন্যদের কাছে কেমন লাগবে, সেটা ভাবার কথা মনে আসেনি। ১০-১৫ মিনিট পরে কাক ভেজা হয়ে সেদিন বাসে উঠেছিলাম, ১ ঘন্টার জ্যামে বাসে বসেই শুকিয়ে গেছি, তাই বাসার মানুষেরা টের পায়নি! বৃষ্টির এরকমই এক আশ্চর্য দখল আমার উপর।



আজকে এই ভর দুপুরে রোদটা একটু কম কম লাগছে। 
আকাশে কি তাহলে কিছু মেঘ আছে? 
বৃষ্টি নামবে নাকি??

Comments

Popular posts from this blog

Sylhet 2009 (Day 3): The Other Side of the Fence

মন্ত্রমুগ্ধ

ড: হাসিবের গল্প