নূরের শহরে (১) - প্রথম নিঃশাস


কয়েক ঘণ্টা তো হয়ে গেল প্লেন ছেড়েছে। কোন শহরের উপরে এখন আমরা? গন্তব্যের দেশটার সীমানা ভেদ করেছি, সেটা জানি, আর গন্তব্য শহরের বেশ কাছাকাছিই আছি, সেটাও বলে দিচ্ছে আমার সামনের স্ক্রীনের লাইভ ম্যাপ। এয়ার ট্র্যাভেলে এই চ্যানেলটাই আমার সবচেয়ে প্রিয়।
 


একটু পর পর তাকাচ্ছি আমার পাশের জানালা দিয়ে। নাহ, নিচে এখনও ঘোর অন্ধকার। আসেনি এখনও সেই শহর...
 


কিছুক্ষণ পর, বাইরে তাকাতেই চোখে পড়ল আলো, কালোর মাঝে অসংখ্য বৈদ্যুতিক আলো। সামনের ডিসপ্লেতে চোখ বুলালাম। এই তো! অপেক্ষার পালা শেষ। আমার নিচেই এখন সেই নূরের শহর, আমার স্বপ্নের শহর, শান্তির শহর......
 


এই শহর যখন প্রথম চোখে পড়বে, তখন পড়বার জন্য বিশেষ একটি দুআই আছে! অনেকক্ষণ ধরে প্র্যাকটিসও করে রেখেছি। জানালায় মাথা ঠেকিয়ে, চোখ বড় করে তাকিয়ে পড়তে শুরু করলাম......



ও আল্লাহ ! এইতো তোমার নবীর শহর ! একে আমার জন্য জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষার, শাস্তি আর খারাপ হিসাব থেকে নিরাপত্তার মাধ্যম বানিয়ে দাও ! (ভাবার্থ)

কি আশ্চর্য দুআ! আমাদের ঈমান, আমল, তওবা, কান্নাকাটি, সব তো জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্যে। দুনিয়ার জীবনের সফলতাই বলা হয়েছে জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে যাওয়াকে। জাহান্নাম থেকে কাঙ্খিত সেই মুক্তি চাওয়া হচ্ছে কিসের দোহাই দিয়ে? একটা শহরের দোহাই দিয়ে! কি আজব এই শহর! আল্লাহর কাছে কতই না প্রিয়, কতই না দামি। কি আছে এই শহরে? অন্য সব নগরের মতোই তো, আছে রাস্তা-ঘাট, অলি-গলি; চলছে গাড়ি, ব্যস্ত মানুষ ছুটছে; আছে ধুলা-বালি, আছে সবুজ; আছে ট্র্যাফিক সিগনালে বসে থাকা; আছে বিভিন্ন স্তরের মানুষ, আর তাদের বিভিন্ন স্তরের বাড়ি; আছে বিশাল শপিং মল, আবার রাস্তার পাশে বিছানো চাদরের উপর জামা কাপড়ের দোকান, যেখানে জামাগুলো ঠিক ভাঁজ করে রাখা হয়না। আপনার আমার সবার শহরেই তো থাকে এগুলো। তাহলে কি আছে এই শহরে যা অন্য কোথাও নেই? 
 
 
 
হ্যা, এই শহরে যে আছেন আল্লাহ'র প্রিয়, সারা সৃষ্টির সেরা মানুষটি! প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আর তাঁর সাথে এখানেই তো শুয়ে আছেন তাঁর কত শত প্রিয় সাথীরা! রাদিয়াল্লাহু আনহুম! এই শহরে যা আছে, তা আর কোথাও নেই। আর তাই তো এই শহরের দোহাই দিয়ে আল্লাহর কাছে বায়না ধরা যায়! মুক্তি চাওয়া যায় আগুন থেকে, শাস্তি থেকে! যেই মানুষগুলোর কারণে এই শহরের এতো দাম, না জানি সেই মানুষগুলোর কত দাম! না জানি তাঁদের জীবনের কত দাম। আর তাঁদের ভালোবেসে, তাদের পথে হাঁটতে চেষ্টা করলে, আমরাও না জানি কতই না দামি হবো আল্লাহ'র কাছে! সেটা যদি বুঝতাম, তাহলে আর এই পথে হোঁচট খাওয়ার ভয় পেতাম না, কারও বাঁকা কথায় দমে যেতাম না।

তুমিই তো নিয়ে গিয়েছিলে আমাকে ......


আমি খুব এনজয় করি যখন প্লেন থেকে যাত্রীদের নামানো হয় টারম্যাকে, অর্থাৎ এয়ার পোর্টের বাইরে, খোলা আকাশের নিচে। প্লেনের দরজার সাথে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার এর পাইপের মতো টানেল দিয়ে বিল্ডিয়ে ঢুকিয়ে দিলে ভালো লাগে না। এবার সেরকম হলো না। যাত্রী নামানো হচ্ছে রাতের তারা ঝলমলে আকাশের নিচে, আমাদের নেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে বাস। বাবা মা আর আমার ছোট ফুপার সাথে সফর (তিন ডাক্তারের সাথে এক রোগী), আমরা বের হবো সবার শেষে। বাবার আস্তে ধীরে বের হওয়া পছন্দ। তাড়াহুড়া কিসের? (যদিও মা'কে নিয়ে বাসা থেকে কোথাও বের হতে গেলে সব সময় মা'কে তাড়ার উপর রাখে।) সবাই বের হয়ে গেল একে একে। বাবা বের হল প্লেনের দরজা দিয়ে, সাথে ফুপা, তারপর মা, তারপর আমি.......
 
 
প্লেনের দরজার ঠিক বাইরে, সিঁড়ির ধাপগুলো শুরু হবার আগে ছোট প্লাটফর্মটায় দাঁড়ালাম। পানি জমা চোখের ঝাপসা দৃষ্টিতে চারপাশে তাকালাম, আর অনেক জোরে একটা শ্বাস নিলাম। আমার ফুসফুসে ঢুকে গেলো মদীনার বাতাস, মদীনার ধূলিকণা! আমার শরীরের ভেতরে এখন মদীনার কিছু অংশ! গলা ধরে ছিল, চোখ ভিজে ছিল আগে থেকেই, এবার আর বাকিটা চেপে রাখতে পারলাম না। কাঁদতে লাগলাম ফুঁপিয়ে। এক পা এক পা করে নামছি সিঁড়ি দিয়ে, আর চোখ দিয়ে পানি পড়ে যাচ্ছে। বাবা চলে গেছে প্রায় বাসের কাছে, তবে পেছনে ফিরে মা দেখলো আমাকে কাঁদতে। হাত ধরে কি যেন বলছিলো, মনে নেই এখন। তবে কান্নার মধ্যে দিয়ে আমার মুখ দিয়ে শুধু একটা কথাই বের হলো, মা'র হাত ধরে... 
 
 
'আমি এখান থেকে যেতে চাই না.....'
 
 
খুবই আশ্চর্য ব্যাপার তাই না? মাত্র তো আসলাম, এখনো নামিইনি পুরোপুরি বিমান থেকে। এখনই কেন যাওয়ার কথা মনে হলো আমার? কেন 'ছেড়ে যেতে হবে', এই কষ্টে বুকটা মোচড় দিচ্ছে মদীনায় পা ফেলার আগেই? আসলে এই শহরটা এমনই। যে এই শহরে আসবে, মনের মধ্যে কিছুটা হলেও আল্লাহ'র মহব্বত নিয়ে, আল্লাহ'র নবী'র প্রেম নিয়ে, সে চাইবে এই শহরের মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকতে। মানুষ যখন কোনো কিছুকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলে, মনে হয় সেটা নিয়ে এই অনুভূতিটা তার পিছু ছাড়েনা, প্রথম থেকেই। আমারও সেটাই হলো। আগমনের আনন্দ ছাপিয়ে, শ্বাসরোধ করে ধরলো 'আর মাত্র পাঁচ দিন পর ছেড়ে যেতে হবে', এই বেদনা। আশ্চর্য, খুবই আশ্চর্য। 

Comments

Popular posts from this blog

Sylhet 2009 (Day 3): The Other Side of the Fence

মন্ত্রমুগ্ধ

ড: হাসিবের গল্প