মন্ত্রমুগ্ধ


দুই ঘন্টা লম্বা তারাবীহ মাত্র শেষ হলো।  তারাবীহের সময়ে মসজিদের ভেতরের লাইটগুলো বন্ধ থাকে, নামাজ শেষ হতেই এক সাথে অনেকগুলো লাইট জ্বলে উঠে, আর সবাই চোখ পিট্ পিট্ করতে করতে মসজিদ থেকে বের হতে থাকে। এই ব্যাপারটা দেখতে আমার কেন জানি খুব মজা লাগে। কিছুক্ষণ বসে থেকে লোকজনের চোখ পিট্ পিট্ দেখি, তারপর নিজেও রওনা দেই। 

সেদিন অবশ্য বাসায় না গিয়ে মসজিদের দক্ষিণ পূর্ব কোণাটায় গিয়ে পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম। দীর্ঘ নামাজে আজকাল পা ধরে আসে। নামাজ শেষ হলেও সাত আটজন মুসল্লি মসজিদের এই কোণায় জড়ো হয়েছে। একটু পরেই এক ভাই চা নিয়ে আসলো পেপার কাপে। চা খেয়ে চাঙ্গা হয়ে ওরা আবার নফল নামাজে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে! চা শেষ করে কাতার বানিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো তারা। নামাজ পড়াতে সবার সামনে এগিয়ে গেলো একজন। বারো কি তেরো বছরের ছেলে। শুরু করলো তিলাওয়াত। 

সে হাফেজ যুবায়ের আবদুল্লাহ। 

আমাদের 'যুবুন পাতা'। 

-------------------------------------

আমার ভাগনে যুবায়েরের জন্ম আমার গ্র্যাজুয়েশনের ঠিক পর পর। আল্লাহর প্ল্যান অনুযায়ী এর পরে ছয়টা মাস আমি কমপ্লিটলি বেকার! তাই যুবায়েরকে কোলে কাঁখে করার জন্য ওর বাবা মা'র পরে আমি পারফেক্ট চয়েস। শুধু সেই ছয় মাস না, বরং দুই বছর পর মালয়েশিয়া যাওয়ার আগ পর্যন্ত ওকে হ্যান্ডেল করার সুযোগ হয়েছে ভালো মতোই।   

'ওকে একটু রাখ, আমি পাঁচ মিনিট ঘুমাই ..... ' বলে আমার কাছে ওকে দিয়ে শুয়ে পড়তো আমার বোন। সেই পাঁচ মিনিট কখনো কনভার্ট হতো আধা ঘন্টায়, কখনো এক ঘন্টায়, কখনো বা আরো বেশি। আমি ডাকতাম না, ঘুমাক আরেকটু। যুবায়েরকে আমি ঘুম পাড়াতাম কখনো পুশ চেয়ারে ঠেলে ঠেলে, কখনো কম্পিউটারের সামনে বসে (বাম হাতের উপর ও ঘুম, ডান হাতে মাউস) অথবা কখনো কোলে নিয়ে হেঁটে হেঁটে। পুশ চেয়ারে শুইয়ে ওকে কখনো মোবাইলে সূরা কাহাফ শুনাতাম (শুনতে শুনতে আমার নিজেরই মুখস্ত হয়ে যায় অনেকটা), আবার কখনো স্বরচিত অর্থহীন কোনো গল্প ফাঁদতাম। আবার কখনো শুনাতাম ঘুম পাড়ানো গান, সেটাও স্বরচিত - 

পু পু পু , পু পু পু 

যুবুন যায়, তোমরা দেখো!

পু পু পু , পু পু পু 

যুবুন যায়, তোমরা দেখো!

ফুল ছিটাও, রং ছিটাও, 

ফুল ছিটাও, রং ছিটাও, 

বেলুন ওড়াও, তোমরা দেখো!

যুবুন যায়, তোমরা দেখো!!

এক এক সময় এক একটা 'প্রিয় জিনিস' থাকতো ওর। কখনো সেটা টর্চ লাইট, কখনো মাইক আর স্পিকার। আমার কোলে ঘুমানো সেই ছোট যুবুনের প্রিয় ছিল 'চাচিপ' ! এটা আবার কি? আসলে এটা চামুচ। ওর ভাষায় চাচিপ। কাঁধের উপর পড়ে থাকতো, হাতে থাকতো একটা চাচিপ। একসময় যখন ও ঘুমিয়ে যেত, তখন চামুচটাও হাত থেকে পড়ে যেত মাটিতে। এতেই বুঝতাম, উইকেট ইজ ডাউন। 

যুবায়েরকে বড় করার পেছনে আমার কন্ট্রিবিউশন খুব একটা বেশি না, তবে এই ঘুম পাড়ানোর সেশনগুলো কেন যেন একটু বেশিই মনে পড়ে অন্য সব কিছুর চেয়ে। তবে আরেকটা ব্যাপার আমার নিজের কাছে একটু বেশি সিগনিফিকেন্ট, সেটা হলো ওকে মাদরাসা থেকে আনা নেয়া। এটা আমার রেগুলার কোনো ডিউটি ছিল না, পার্ট টাইম বলা যায়। কিন্তু আমি খুব এনজয় করতাম। বিশেষ করে ওর হিফজ শুরু হওয়ার পর যে সময়টা ও প্রফেসর হজরত হামিদুর রহমান সাহেবের মাদরাসায় পড়তো। আমার নিজের কাছে খুব প্রিয় একটা যায়গা ছিল পুরনো ওই বিল্ডিং। সোমবারের সত্যিকার অর্থে 'নূরানী' মাহফিল কি যে ভালো লাগতো! মাহফিলে প্রায় প্রায়ই কিছু ছোট পাখির হিফযের প্রথম সবক দেয়া হতো। সেই সাথে তাদের গার্ডিয়ান কেও ডেকে দাঁড় করানো হতো! কত গর্বের, কত শুকরিয়ার ছিল সেদিন, যেদিন মাহফিলে ঘোষণা হলো, 'আজকে হিফযের প্রথম সবক নিবে যুবায়ের আব্দুল্লাহ, ওর সাথে এসেছে ওর মামা'। হাসি মুখে দাঁড়িয়ে গেলাম দেরি না করে। বুক ভরা শুকরিয়ার অক্সিজেন। 

ওর বাবা মায়ের কত শত কষ্টের পর, কবে কোনদিন কিভাবে যেন একেবারে পুরোপুরি হাফেজ হয়ে গেলো যুবায়ের! মাস কয়েক আগে যেদিন ওকে পাগড়ি দেয়া হলো, সেদিনও ছিলাম আমি। এই দৃশ্য দেখার সুযোগ ছাড়া অসম্ভব।  

-------------------------------------

দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা, সূরার পর সূরা পড়ে যাচ্ছে যুবায়ের। ভাবছি, নিশ্চই এই সুরাটার পরেই রুকু করবে, কিন্তু করছে না। পরের সূরা শুরু করে দিচ্ছে! ওর যেন কোনো ক্লান্তি নেই। তিলাওয়াত করতে থাকাই যেন ওর জন্য সহজ, থেমে যাওয়ার চেয়ে। আধা ঘন্টারও বেশি সময় ধরে দুই রাকাত পড়ালো যুবুন। তারপর একটা ছোট টি-ব্রেক নিয়ে আবার দুই রাকাত। সে রাতে চার রাকাতে দুই পাড়ারও বেশি তিলাওয়াত করেছে সে! দিলের ভেতর এইভাবে কুরআনের এক একটা অক্ষর, শব্দ, বাক্য গেথে লক্ষ্য লক্ষ্য যুবায়ের ছড়িয়ে আছে দুনিয়ায়। এরকম যুবায়ের প্রোডাকশন শুরু করেছেন স্বয়ং আল্লাহ'র রাসূল (স) তাঁর সাহাবীদের মধ্যে। কিয়ামত পর্যন্ত চলবে এই ধারা। কুরআন নাযিলের পর থেকেই তৈরী হতে থাকা হাফেযদের গ্যালাক্সির অগণিত নক্ষত্রের মধ্যে একটা আমাদের যুবায়ের। আমাদের পরিবারে প্রথম। First of many, InshaAllah.

অবাক বিস্ময়ে, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছি যুবায়েরের তিলাওয়াত। ভাবছি, কিভাবে সম্ভব এভাবে অন্তরে কুরআন গেথে নেয়া? আর চাওয়া মাত্রই এতটা অনায়াসে, স্বাচ্ছন্দে, সাবলীলভাবে তা বাতাসে ছড়িয়ে দেয়া? এই চিন্তার জবাব দিতেই যেন সেদিন তিলাওয়াতে চলে আসলো সূরা আল-কামার। আল্লাহ'র জন্য কোনো কথা তো একবার বলাই যথেষ্ট। কিন্তু এই সূরায় তিনি চারবার একই প্রশ্ন আমাদেরকে করেছেন ,

وَلَقَدْ يَسَّرْنَا ٱلْقُرْءَانَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِن مُّدَّكِرٍۢ 

And We have certainly made the Qur’ān easy for remembrance, so is there any who will remember? (54:17)

আল্লাহ যা সহজ করেছেন, সেটা তো কঠিন হওয়ার প্রশ্নই আসেনা! শুধু আমাদের সাহসের, আমাদের নিয়তের দুর্বলতা। যুবায়ের তো এখন শুধু কুরআনের শব্দমালার সংরক্ষক। এভাবেই একদিন কুরআনের অর্থ, ব্যাখ্যা, হুকুম আহকাম আর কুরআন নিয়ে আসা নবীজির (স) সুন্নাহরও ধারক বাহক হয়ে যাবে সে। ওর ব্রেইন হবে কুরআনের জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া, ওর জীবন হবে কুরআন-সুন্নাহর লাইভ স্যাম্পল। ইনশাআল্লাহ!  

[পুনশ্চ: এই লেখা পড়তে পড়তে কারো যদি এরকম আফসোস মনে এসে থাকে 'আহারে, বাচ্চাটাকে মাদ্রাসায় কেন দিল....' তাদের জন্যও আমার ভালোবাসা। কারণ আসলে তারাও আমাদের ভালোবাসে, তাই তারা আমাদের শুভাকাঙ্খি, আমাদের সফলতা প্রত্যাশী। শুধু পার্থক্য হলো সফলতার সংজ্ঞা আমাদের কাছে এক না। ছোট জীবনটা শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই আমরা যেন সত্যিকরার সফলতা চিনতে পারি, সেই দুআ আমাদের সবার জন্য।]

Comments

  1. Anonymous5:03 PM

    মাশাআল্লাহ। অসাধারন। পড়তে পড়তে চোখে পানি চলে আসলো।

    ReplyDelete
  2. Anonymous8:46 PM

    So nice, Alhamdulillah.

    ReplyDelete
  3. Anonymous3:31 PM

    এমনভাবেই ঘুমাত যুবায়েরের বাপ আমার কাধে।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

Sylhet 2009 (Day 3): The Other Side of the Fence

ড: হাসিবের গল্প