সেলফ পোর্ট্রেট
১. তিনি সব সময় গরিব মানুষদের খোঁজ খবর নিতেন, তাদের সাহায্য করতেন। বিশেষ করে পথের খেটে খাওয়া মানুষদের ভালো কথা বলা, দ্বীনের কথা শোনানোর ব্যাপারে খুব চেষ্টা করতেন।
২. কখনও অভিযোগ করতেন না। সব সময় হাসিখুশি থাকতেন। তীব্র অসুস্থতার মধ্যেও আল্লাহ'র শুকরিয়া করতেন।
ইন্তেকাল করা এই ভাইয়ের আরও অনেক পরিচয় ছিল। ক্যারিয়ারের দিক থেকেও তিনি ছিলেন খুবিই সফল একজন মানুষ। কিন্তু তার সাথে দৈনন্দিন জীবনে চলাফেরা করা একজন ভাইয়ের দৃষ্টিতে এগুলোই তার বিশেষ বৈশিষ্ট। তার কথা মনে করলে যে চিত্রটা ফুটে উঠে, তার ভাই সেই চিত্রটাই বর্ণনা করেছে।
___________________________
সপ্তাখানেক আগে মারা গেলেন আমাদের ১৪ নম্বর সেক্টর মসজিদের অতি পরিচিত নজরুল ইসলাম
চাচা। তাবলীগের কাজের কারণে বেশ কাছ থেকে দেখেছি চাচাকে। এক সাথে তিন দিনের জামাতে সময় দিয়েছি বেশ কয়েকবার। এখন যদি উনাকে মনে করার চেষ্টা করি, তাহলে যেই ছবিটা ফুটে উঠে সেটা কেমন?
সব সময় মুখে লেগে থাকা স্মিত হাসি।
চশমার পেছনে বুদ্ধিদীপ্ত , স্মার্ট, ইন্টেলিজেন্ট এক জোড়া চোখ।
অত্যন্ত গুছিয়ে, সিস্টেমেটিক কথা বলা।
খুব কম খাওয়া।
তার আরও অনেক পরিচয় থাকা সত্ত্বেও মনে গেথে থাকা উনার ছবিটা আমার কাছে এমনই। তবে সেই সাথে উনার জীবনের শেষ মুহূর্তের যে বর্ণনা শুনেছি, সেটাও কখনো ভুলে যাওয়া সম্ভব না। সেই গল্পটা এখানে না করলাম। আরেকদিন হবে।
_______________________________
এই ভদ্রলোক নিশ্চয় চাননি যে মানুষ তাকে মনে রাখুক 'মসজিদ থেকে নামাজ শেষে সবার আগে জুতা হাতে বের হয়ে যাওয়া মুসল্লি' হিসেবে! উনার তো আরও অনেক বৈশিষ্ট ছিল, আরও অনেক পরিচয় ছিল। কিন্তু উনার যে চিত্রটা মুসল্লিদের মনে আঁকা হয়ে গেছে, সেটা তো এখন আর পরিবর্তন হবে না।
_____________________________
গত কয়েকমাসে কোভিড এর ধাক্কায় বেশ কিছু বিগ শটের উইকেট পড়েছে। তাদের মধ্যে একজনের কথা বলছি। অনেক অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। তার প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকরি করে হাজার হাজার মানুষ। রাজনীতির মাঠেও বেশ সফল জীবন। পরিচয়ের অভাব নেই। কিন্তু তার অধীনে তার কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা এমপ্লয়িদের কাছে তার চিত্রটা কেমন? এমন একজন মানুষ, যার কপাল সবসময় কোঁচকানো, মুখে অনবরত গালিগালাজ, যে কাউকে তুই তুই করে কথা বলা, এমনকি তার থেকে বয়সে অনেক বড়দেরকেও। অথচ এই লোকটা কয়েকদিন পরপরই তার নিজ এলাকা সহ অনেক জায়গায় দান করেন, ত্রাণ বিতরণ করেন। অনেক লোকের কর্মসংস্থান করেছেন তিনি। কিন্তু তার কথা মনে পড়লে তার কর্মচারীদের মনে এসব চিত্র কখনোই প্রথমে উঠে আসে না। অপ্রীতিকর অনেকগুলো ছবি সরালে তারপর পাওয়া যায়। অপরিচিত অসংখ্য মানুষের কাছে দয়া দেখিয়ে, পরিচিত কাছের মানুষদের সাথে দিনের পর দিন করে যাওয়া দুর্ব্যবহারের চিত্র মুছে ফেলা যায় না।
______________________________
আচ্ছা, আমিও তো চলে যাবো। মসজিদে একদিন আমার জানাজার ঘোষণা হবে। অফিসের মেইলে নোটিস দেয়া হবে। আমার কথা মনে হতেই কেমন ছবি মানুষের মনে উঠে আসবে?
'ওই যে লোকটা, সব সময় হাসি মুখে কথা বলতো। ......'
নাকি 'চিনলেন না, ওই যে মুখ বেজার করে রাখতো সব সময়.....'
'কখনো দেখিনাই উনাকে রাগ করতে। ......'
নাকি 'উনারে তো প্রতিদিন দেখতাম রিকশাওয়ালারে গালি দিতো। .....'
'আরে আসিফ স্যারকে চিনলি না, খুব ফ্রেন্ডলি ছিল, ভালো পড়াতো। ....'
নাকি 'ওই যে ওই ফাঁকিবাজ স্যারটা। খালি মেজাজ খারাপ করতো। ...'
'খুব বিনয়ী ছিল ছেলেটা, মাথা নিচু করে চলতো। .....'
নাকি 'অহংকারী টাইপের লোক ছিল, কোনোদিন দেখলাম না আগে সালাম দিতে। ...'
_______________________________
আমাদের আশেপাশের মানুষগুলোর মনে আমাদের নিজেদের সেলফ পোর্ট্রেট আমরা এঁকে যাচ্ছি প্রতিদিন। নিজের এই রেখে যাওয়া ছবিটা কেমন হবে, সেটা নিছক আমাদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না। আমাদের চালচলন, আমাদের কথা, আমাদের বডি ল্যাংগুয়েজ, আমাদের অভ্যাস, মোটকথা প্রতিদিনের, প্রতি মুহূর্তের কাজের উপর নির্ভর করে। ছবি আঁকা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কখনো বাবা মায়ের মনে, কখনো ভাই বোনের মনে, স্ত্রী সন্তানদের মনে, কিংবা বন্ধুবান্ধব, অফিসের কলিগদের মনে, প্রতিবেশীদের মনে। তাদের সাথে কাঁটানো প্রতিটা মুহূর্ত একেকটা কলমের টান, একেকটা তুলির আঁচড়। একদিন শেষ হবে এই ছবি আঁকা। হঠাৎ করেই রেখে দিতে হবে রং তুলি। হয়তো ইচ্ছা ছিল ছবিতে কোনো কারেকশন করার। একটি অংশ মুছে নতুন করে, আরেকটু সুন্দর করে আঁকার। কিন্তু সময় শেষ হয়ে গেলে আর ঘষামাজা করা যাবে না। যেভাবে আছে সেভাবেই ছেড়ে দিতে হবে।তাই নিজের সেলফ পোর্ট্রেটটা সুন্দর করে আঁকতে চাইলে, কোনো কারেকশন করতে চাইলে, সেটা করতে হবে এখন থেকেই।
Darub
ReplyDelete