বদলি


অফিসের গাড়ি ছাড়ে ঠিক পাঁচটায়। এক সেকেন্ড আগেও না, পরেও না। কাজ গুছিয়ে নীচে নামতে নামতে প্রায় দেরিই হয়ে যাচ্ছিল। বিল্ডিংয়ের সামনে গাড়িটা দেখে হাফ ছাড়লো জামিল। নীল রঙের টয়োটা হাইএস। দশজনের বসার সিট থাকলেও জামিলদের প্রায়ই বার-তেরো জন বসা লাগে। আজকে কি অবস্থা কে জানে। স্লাইডিং দরজাটা খুললো জামিল।

'
উঠে পড়ুন জামিল ভাই, আজকে আপনার জন্য একেবারে মাঝখানের সিট, ভিআইপি বলে কথা!' সদাহাস্য (অনেকটা অতিহাস্য) রাহাত ভাই বললেন একেবারে পিছনের সারি থেকে। দরজার সামনেই বসে থাকা স্বল্পভাষী অর্ণব ঘুরে বসেছে জামিলকে উঠার জায়গা দিতে। জামিলের জন্য জায়গা খালি মাঝের সারির মাঝের সিটে। সারির শেষ সিটে বসে আছে এইচআর এর আফসানা। পাশে বসে পড়লো জামিল। গাড়ি ছেড়ে দিলো তাদের ইপিজেডের অফিস থেকে।

জয়েন করার পর প্রথম দিকে কোনো ম্যাডামের পাশে বসতে অস্বস্তি লাগতো দাড়ি-টুপি ওয়ালা 'হুজুর' জামিলের। সে চেষ্টা করতো এভয়েড করতে, না পারলেও বসত প্রচন্ড অস্বস্তি নিয়ে। কিন্তু এক বছর যেতে এখন আর এতটা খারাপ লাগে না। সব কিছুই গা সওয়া হয়ে যায় সময়ের সাথে। অফিসের প্রয়োজনে আমি অপারগ, নিজেকে বোঝায় জামিল।

- '
কি খবর জামিল সাহেব', সামনে থেকে ঘুরে তাকালেন ফেরদৌস স্যার, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজার।
- '
এইতো চলছে ভাই, আলহামদুলিল্লাহ'
- '
অফিস এনভাইরোনমেন্টে সিনিয়রকে ভাই ডাকলেন, বদলি হয়ে যাবেন কিন্তু, হাহাহাহা।' অট্টহাসি দিয়ে উঠলো রাহাত, অন্য কলিগরাও হেসে উঠলো।
- '
বদলি হলে কিইবা করতে পারবো ভাই।'
- '
আপনি বদলি হলে এই গাড়ির সবাই প্রতিবাদ করবো জামিল ভাই', রাগের ভান করে বললো আফসানা। সায় দিলো অন্যরা।

অফিসে জামিল বেশ জনপ্রিয়। বয়সে ৩৩, অফিসের অনেক তরুণ মুখের থেকে সিনিয়র। এর আগে কয়েক জায়গায় চাকরি করেছে জামিল, দেশের বাইরেও। তাই অভিজ্ঞতার ঝুলিটা ভালোই। সেই সাথে জামিলের কথা বার্তা, চালচলন খুব smartঅফিসের সবার সাথেই তার ভালো, সহজ সম্পর্ক। একদিকে জামিলের সিনিয়ররা তাকে গুরুত্ব দেয়, আর জুনিওররা তাকে বড় ভাইয়ের মতো দেখে। সেই সাথে তার আরেকটা খ্যাতি আছে স্মার্ট হুজুর হিসেবেও।

সিএমবি মোড় থেকে আরেকজন ওঠার কথা, মনজুর স্যার। পিছনে ঘুরে দেখলো জামিল। পেছনের দুই সারিতেই তিন জন করে বসা। মনজুর স্যারের উঠতে হবে হয় সামনের ড্রাইভার আর প্যাসেঞ্জারের মাঝের 'বেবি সিটে', নাহলে ওই সারিতেই বসে যাবে চেপেচুপে।

গাড়ি থামলো। দরজা টেনে ভেতরে তাকালেন মনজুর সাহেব।
- '
বেবি সিটে উঠে পড়ুন স্যার', বললেন কামরুল।
- '
ওখানে পা রাখারও জায়গা নেই। চেপে বস অর্ণব।'
অর্ণবের না চেপে উপায় নেই, মনজুর তার ইমিডিয়েট বস। অর্ণবের চাপে জামিলকেও চেপে বসতে হবে।
- '
সরে আসুন জামিল ভাই', হাসিমুখে বললো আফসানা।
জামিল চেপে বসলো আফসানার গা ঘেষে।

-----------------------------------------------------

আফসানার পারফিউমের মিষ্টি গন্ধটা নাকে লাগলো জামিলের। গন্ধটা সে চেনে, Lavenderগত মাসেই জামিল তার স্ত্রী মুনিয়াকে কিনে দিয়েছে এই ফ্রেগ্রান্স। আর অর্ণবের কাছ থেকে চব্বিশ ঘন্টাই সিগারেটের গন্ধ আসে। একদিকের নাক বন্ধ করতে পারলে ভালো হতো। কানে হেডফোন লাগাতে যাচ্ছিল জামিল।

- '
আজকে ভাবি লাঞ্চ কি দিলেন?' আফসানা প্রশ্ন করলো।
- '
আজকে লাঞ্চ আনিনি ম্যাডাম , একটু বের হয়েছিলাম। লাঞ্চ বাইরে করতে হলো।'
- '
ও আচ্ছা। বেঁচে গেলেন, না হলে আমি ভাগ বসাতাম!'
- '
আমি পুরোটাই দিয়ে দিতাম ম্যাডাম।'
- '
থ্যাংকস জামিল ভাই'

'
জামিল ভাইয়ের লাঞ্চ মেরে দিলে আপনার কিন্তু বদলি হয়ে যেতে পারে ম্যাডাম , হাহাহা।' অপ্রয়োজনীয়ভাবে আবার একই বদলি রিলেটেড জোক করার চেষ্টা করলো রাহাত। এবার হাসিতে কেউ যোগ দিলো না। ছেলেটা খামাখা নিজেই নিজেকে পঁচায়। কিছু পাবলিক আছে এরকম, পঁচতে ভালোবাসে।

তবে ও আর পঁচার সুযোগ পেলো না। কামারপাড়া পৌঁছে গেছে গাড়ি, এখানে নেমে পড়লো রাহাত।
জামিলের সারির চাপ একটু কমলো, পেছনে গিয়ে বসলো মনজুর।

- '
কালকে তো ব্রাজিল প্রায় হেরেই গিয়েছিল মনজুর স্যার', কামরুলের খোচার চেষ্টা।
- '
আর আপনার আর্জেন্টিনা তো আগেই বাদ, তাই না?' হাসির রোল উঠলো গাড়িতে।

- '
জামিল ভাই কি ব্রাজিল না আর্জেন্টিনা?' আফসানা জানতে চাইল।
- '
এই প্রশ্নটা এখন অনেকটা কোরবানির সময়ের মতো হয়ে গেছে, আপনি গরু না খাসি?'
সবাই হেসে উঠলো।
- '
আরে কেউ তো উট দুম্বাও দিতে পারে। আমিও তেমন। আমার টিম এত বেশি ভালো যে বিশ্বকাপে খেলছেই না। হল্যান্ড।'
- '
হম্ম বেশ বেশ, ডিফারেন্ট চয়েস।' লাইক দেখালো আফসানা। বিনয়ের ভান করে মাথা ঝোঁকাল জামিল।

পাঞ্জাবির ডান দিকের পকেটে ভাইব্রেশন টের পেলো জামিল, সাথে আফসানাও। 'সরি ম্যাডাম' বলে তাড়াতাড়ি হাতড়ে ফোন বের করতে লাগলো জামিল।
- '
না না it's ok'

মুনিয়া ফোন দিচ্ছিল, বের করতেই কেটে গেল। জামিল ভাবলো, একবারে গাড়ি থেকে নেমেই কল দিবে।

- '
আপনার ফোনটা তো সুন্দর, নতুন নাকি?' জামিলের ফোনের দিকে ঝুকে এসে বললো আফসানা।
- '
আরে নাহ, দুই বছর হয়ে গেল। পুরানোই বলা যায়। এখন তো ছয় মাসের বেশি কেউ একই ফোন রাখে না।'
হাসলো আফসানা। 'যাই বলেন, আপনার ফোনটা বেশ স্মার্ট লুকিং।'
জামিলের হাত থেকে ফোনটা নিলো আফসানা। কিছুটা হকচকিয়ে গেল জামিল। আফসানার হাতটা অল্প সময়ের জন্য স্পর্শ করেছিল জামিলের হাত।
- 'Unlock
করে দেই,' ফোনটার লক খুলে দিলো জামিল। এই ফোনটা তার সত্যই প্রিয়।

- '
ক্যামেরার কোয়ালিটি বেশ ভালো, ছবিগুলো দেখতে পারেন।' গ্যালারি তে ছবি দেখতে লাগলো আফসানা আর জামিল।
- '
এটা গত পরশু তোলা। Takeout এ।'
- '
ক্যামেরা যতই ভালো হোক, আপনার ফটোগ্রাফি স্কিল অসাধারণ।'
কথাটা ভুল না, জামিল ছবি ভালো তোলে বরাবরই।
- '
এটা গত এপ্রিলের, সিলেট গিয়েছিলাম। রাতারগুল।'
- 'Wow, fantastic!'

সোয়াইপ করতে করতে হঠাৎ মুনিয়ার ছবি এসে পড়লো স্ক্রিনে। শাড়ি পরে জামিলের ফোন দিয়ে ছবিটা নিজেই তুলেছিল সে।

- '
জামিল ভাই, ভাবি যে নায়িকার মতো সুন্দরী তা তো জানতাম না। হতেই হবে, না হলে আপনার সাথে যেত না!'

স্ক্রিনে মুনিয়ার ছবি দেখে হঠাৎ অদ্ভুত খেয়াল হলো জামিলের। মনে হলো মুনিয়া তাকিয়ে আছে ওর দিকে, ওদের দিকে। আচ্ছা, ওদের এভাবে গল্প করতে দেখে মুনিরা কি বলতো?

আরে নাহ, এটা তেমন কিছু তো না। এক সাথে চাকরি করতে গেলে এরকম কমুনিকেশন হবেই। নিজেকে বোঝালো জামিল। আবারও ছবি দেখায় ফিরলো ওরা।

- '
এটা গত বছরের, আমাদের বাসার ছাদের গোলাপ।'
- '
স্যার কোথায় যাবেন আজকে?' ড্রাইভারের প্রশ্নে ভড়কে গেল জামিল।

আশে পাশে তাকিয়ে অবাক হলো। সে খেয়ালই করে নি, একে একে গাড়ি থেকে নেমে গেছে সবাই, শধু সে আর আফসানা বাদে। তার পাশের সিট খালি হওয়া সত্ত্বেও সে বসে আছে আফসানার গা ঘেঁষেই। বাইরে তাকালো জামিল । নিকুঞ্জ ছেড়ে মনে হচ্ছে চলে গেছে অনেক দূর। ঘড়ি দেখে আরও অবাক হওয়ার পালা। গাড়ি নিকুঞ্জ পৌঁছে সাড়ে পাঁচটায়, এখন বাজে সোয়া ছয়। তার মনে রুটের প্রকয় শেষ প্রান্তে। কিভাবে চলে গেল সময়? খুব embarrassingতবে কাউকে বুঝতে দেয়া যাবে না।

- '
সামনের মোড়ই নামবো ভাই। এদিকে কাজ আছে একটু।'

জায়গাটা একেবারেই চিনতে পারছে না জামিল। তাও নেমে পড়া উচিত। ফিরতে হবে উল্টো দিকে অনেকটা পথ। না চিনলেও সমস্যা নেই। Google Maps তো আছেই।

- '
চলি ম্যাডাম। আসসালাম আলাইকুম।'
- '
ওকে ভাই। ওয়ালাইকুম সালাম। Take care' হাসি মুখে হাত নাড়লো আফসানা।

-------------------------------------------------------------------

গাড়ি থেকে নামলো জামিল। এই জায়গায় জামিল কখনো এসেছে বলে মনে পড়লো না। জন্ম থেকেই ঢাকায় থাকা হলেও ঢাকার অনেক জায়গাই জামিল চেনে না। তবে বাড়িগুলো দেখে মনে হচ্ছে পুরান ঢাকার কাছাকাছি হবে। গলিগুলো উত্তরা, বনানীর মতো না, অনেক সরু।

ম্যাপস বের করলো জামিল। আশ্চর্য, ম্যাপ দেখেও বুঝতে পারছে না সে কোথায়। জুম আউট করলো, নাহ, কিছুই চিনেছে না সে। আকাশে আলো মিলিয়ে আসছে, আসরের নামাজ পড়া হয়নি। একটা মসজিদ খুঁজে বের করতে হবে। মসজিদের শহরে বেশি খুঁজতে লাগার কথা না। সামনের গলি ধরে হাটতে লাগলো জামিল। আবারও চেষ্টা করলো গুগলে ম্যাপস। তার লোকেশন যেখানে দেখাচ্ছে এই জায়গার নাম সে কোনোদিনও শোনেনি। তাছাড়া ম্যাপের আইকোনগুলোও অন্যরকম লাগছে। নতুন আপডেটের কারণে হয়তো।

জামিল লক্ষ্য করলো গলিটা একেবারেই নির্জন। জিজ্ঞেস করার মতো কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। আলো কমে গেছে একবারেই। আসরের ওয়াক্ত প্রায় শেষ। নামাজটা কি কাযাই হয়ে যাবে? দ্রুত পায়ে গলির আরো ভেতরে যেতে লাগলো জামিল। নিশ্চই সামনে কোনো মোড় পরবে, দোকানপাট, লোকজন পাওয়া যাবে। কিন্তু সরু গলিটা হালকা বাক নিয়ে চলে গেছে অনেক দূর। একটা রিকশাও কেন চলছে না এই সময়? জামিলের শরীর ঘেমে গেছে, পরিশ্রমে, টেনশনে।

নাহ, কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। গলিটাও মনে হচ্ছে সীমাহীন। জামিলের পা ধরে আসছে, টানতে পারছে না। হালকা শ্বাসকষ্ট হচ্ছে জামিলের, বুক উঠানামা করছে, চি চি শব্দ বের হচ্ছে নিঃস্বাশের সাথে। হঠাৎ প্রচন্ড ভয় হলো জামিলের। এই ব্যস্ত শহর, এতো মানুষ, এতো বাড়িঘরের মাঝেও 'স্মার্ট' জামিল কিভাবে যেন হারিয়ে গেছে। কান্না আসছে জামিলের, গলা ধরে আসছে।

সে ভাবলো, যেভাবেই হোক, অন্তত নামাজটা পড়তে হবে। যেকোনো একটা বাসায় ঢুকে বলবে একটু নামাজ পড়ার জায়গা দিতে। কে মানা করবে?

জামিলের সামনেই হাতের ডান পাশে পুরোনো স্টাইলের দোতলা বাড়ি। সামনের লোহার গেট খোলাই আছে, কোনো দারোয়ান চোখে পড়লো না। গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলো জামিল। নিচতলার মূল দরজায় টোকা দিলো। কোনো সারা শব্দ নেই। তবে ভেতরে আলো জ্বলছে কোনো একটা ঘরে।

'
আসসালামু আলাইকুম, কেউ আছেন কি?' বলতে বলতে চৌকাঠ পেরিয়ে একটা সিটিং রুমে ঢুকে পড়লো জামিল। সিটিং রুমটা অন্ধকার, বেশ কিছুক্ষন এই রুমে কেউ আসেনি বোধহয়, তাই সন্ধ্যার লাইট জ্বালানো হয়নি। আবারো জোরে সালাম দিয়ে সামনে আগালো জামিল। সিটিং রুমের বা পাশে একটা করিডোর চলে গেছে বাড়ির ভেতরে, করিডোরের মুখে পর্দা ঝুলছে, ভেতর থেকে পুরোনো হলুদ বাল্বের আলো আসছে। পর্দার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকলো জামিল, 'কেউ আছেন কি?'

'
কে যেন এসেছে', কোনো মহিলার গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো। 'একটু দেখোনা কে।' গলাটা কি চেনা মনে হলো?

'
কে আপনি?' বয়স্ক পুরুষের গলা।

'
ইয়ে মানে....আমাকে চিনবেন না। আমি আসলে এই এলাকা চিনি না। একটু নামাজ পড়তে চাচ্ছিলাম। ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে তো.......'

জামিলের কথার মাঝেই পর্দা ফাক করে তাকালেন বয়স্ক এক ভদ্রলোক। ভদ্রমহিলাকেও দেখা যাচ্ছে এখন। জামিলের বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। মাথা ঘুরে উঠলো। এটা কিভাবে সম্ভব? মানুষ দুজন ঠিক তার নিজের...... বাবা মায়ের মতোই! যেন ঠিক জামিলের বাবা মাই, কোনো পার্থক্য নেই! কিন্তু বাবা মা এখানে কেন?

'
কোনো চিন্তা করবেন না, সিটিং রুমে টেবিলের উপরে জায়নামাজ আছে একটা, ঐদিকে পশ্চিম।'

তারা জামিলকে চিনছে না, যেন সে সম্পূর্ণ অপরিচিত! জামিল বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। এতক্ষণে জামিল লক্ষ্য করলো, এই বাসাটাও যেন ঠিক তাদের ছোটবেলার মোহাম্মদপুরের বাসাটার মতোই!

'
কে এসেছে মা?' একটা মেয়ের গলা পাওয়া গেলো। করিডোরের বা পাশের দরজাটা এতক্ষন খেয়ালই করে নি জামিল। সেখান থেকে উঁকি দিলো একটা মেয়ে। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে জামিলের সারা শরীর এবার অবশ হয়ে এলো। মেয়েটা আর কেউ নয়, জামিলের স্ত্রী মুনিয়া।

'
তানিয়া মা, তুই একটু চা বসা তো, ছেলেটা মনে হচ্ছে খুব ক্লান্ত। নামাজ হলে ওকে একটু নাস্তা দে।' মহিলা বললো তার মেয়েকে।

'
আপনি কোনো টেনশন করবেন না, নামাজ পরে সোফায় একটু বসুন, আমি নাস্তা নিয়ে আসছি। একটু বিশ্রাম নিয়ে যাবেন আমাদের বাসায়' জামিলের অতি পরিচিত গলায় বললো মেয়েটা।

জামিল আর নিজের শরীরের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারছে না। তার পা দুটো ভেঙে যাচ্ছে, মাথা ঘুরে উঠছে। অবিশাস্য হলেও, কি হচ্ছে জামিল বুঝতে পারছে, কিন্তু মেনে নিতে পারছে না। জামিলের বাস্তবতা পরিবর্তন হয়ে গেছে। সে চলে এসেছে একটা ভিন্ন জগতে। এই জগতের ঢাকা তার চেনা শহর না। জামিলের যেই বাবা মা তাদের দাড়ি-পাকা ছেলেকে স্কুলের বাচ্চার মতো আদর করে, এই জীবনে তারা তার বাবা মা নন! তাহলে এখানে তার বাবা মা কে? সে তো তাদের চেনেও না! তার নিজের ঠিকানাও জানে না। তার প্রাণ-প্রিয় স্ত্রী মুনিয়া এখানে অন্য কেউ, অপরিচিত। তার ভালোবাসা থেকে জামিল এখানে বঞ্চিত।

জামিলের বদলি হয়ে গেছে। অফিসের বস অসন্তুষ্ট হলে বদলি করেন অন্য শহরে। আর আল্লাহ অসন্তুষ্ট হয়ে জামিলকে বদলি করে দিয়েছেন এক ভিন্ন বাস্তবতায়। ভিন্ন জীবনে।

'
আপনি অমন করছেন কেন....' তাকে ধরতে এগিয়ে আসতে গেলো মেয়েটা। কিন্তু তার কাছে পৌঁছার আগেই জামিল বুঝতে পারল সে পরে যাচ্ছে। মাথা ঘুরে পরে যাচ্ছে পিছনের দিকে। কিন্তু পরাটাকেও মনে হচ্ছে অনেক দীর্ঘ। খুব ধীরে ধীরে মোজাইকের ফ্লোরটা কাছে আসছে .......

-------------------------------------------------------

চিৎকার করে উঠে বসলো জামিল। তার পুরো শরীর ঘামে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে, অথচ রুমের এসি চলছে সারারাত।
'
কি হলো আপনার,' উঠে বসেছে মুনিয়া। জামিলকে ধরে আছে শক্ত করে। 'আপনার শরীর পুরা ভিজে গেছে। ফ্যানটা বাড়িয়ে দেই।' উঠে পড়লো সে।

জামিল দুঃস্বপ্ন দেখছিলো। তবে স্বপ্নটা এখনো জামিলের কাছে বাস্তব মনে হচ্ছে। অনেক বেশি জীবন্ত। স্বপ্নে জামিলের বিভীষিকাময় অনুভূতি এখনো তার মনে সজাগ। আল্লাহর প্রতি প্রচন্ড কৃতজ্ঞতায় সে বিড়বিড় করে আলহামদুলিল্লাহ বলতে থাকলো। আল্লাহ চাইলে তার দুখপ্নটাকেই বাস্তব করে দিতে পারতেন। বদলি করে দিতে পারতেন ভিন্ন জীবনে। কিন্তু তা তিনি করেননি। জামিলকে তিনি সুযোগ দিয়েছেন নিজেকেই নিজের বদলানোর।

-----------------------------------------------------------

পুনশ্চ

সকাল আটটায় এত গরম? পাঞ্জাবি ভিজে গেছে জামিলের। অফিসের গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে আছে নিকুঞ্জ রিজেন্সির সামনে, প্রতিদিনের মতোই। তবে আজকে গাড়িটা বেশি দেরি করছে। কোনোদিন চলে আসে অনেক আগে, কোনোদিন অনেক দেরি করে। আরে আমি কিভাবে বুঝবো গাড়ি কখন আসবে? নির্দিষ্ট টাইম থাকবে না? আশ্চর্য!

গাড়ি এসে পৌঁছলো আরো পনেরো মিনিট পর। স্লাইডিং দরজা খুলে ভেতরে ঢোকার জন্য জায়গা করে দিলো রাহাত। 'উঠে পড়ুন জামিল ভাই, আজকে গাড়ি এমনিই লেইট। বেশি দেরি হলে কিন্তু বদলি হয়ে যাবে। হাহাহা।'

জামিলের জন্য একটাই জায়গা খালি আছে। আফসানার পাশের সিট্।

'
ওহ্হো সরি রাহাত ভাই। ফোনটাই ফেলে এসেছি। আপনারা চলে যান, আমি বাসে চলে আসবো।' রাহাতকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে স্লাইডিং দরজা টেনে লাগিয়ে দিলো জামিল।

Comments

Popular posts from this blog

Sylhet 2009 (Day 3): The Other Side of the Fence

মন্ত্রমুগ্ধ

AUSTronics goes public !